মাধব ঘোষ

ভারতে তীর্থযাত্রীর কাশী এবং পর্যটকের বারাণসী শহর। বারাণসী এক ঐতিহাসিক জনপদ। প্রায় তিন হাজার বছর আগে এর গোড়াপত্তন হয়। বামনপুরাণ, মহাভারত এমনকি বৌদ্ধশাস্ত্রেও বারাণসীর অস্তিত্ত্বের সঠিক বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায়। ভাঙাগড়া, ওঠা-পড়া, সুখ-দুঃখ এর নিত্য দিনের সঙ্গী। যে ভাবেই সৃষ্টি হোক না কেন বারাণসী জীবন-মৃত্যুর মিলন বিন্দুতে এক অপার বিস্ময়ের স্থান। বারাণসীতে যত্রতত্র ষাঁড়ের দেখা মেলে আর সরু গলিপথ-তারই মধ্যে চা, তেলেভাজা, পান মিঠাই আর মুদির দোকান। পথের দুধারে পুরনো বাড়ির সারিবদ্ধ অবস্থান। আদি -অকৃত্রিম প্রাচীন এই সব গলির মধ্যেই লুকিয়ে আছে এই শহরের প্রাণপাখি। এই মন্দিরের অনেক পুরনো ইতিহাস রয়েছে।  বারবার ভেঙ্গে গেছে।  কিন্তু 1777 সালে ইন্দোরের মহারাণী অহল্যাবাই হোলকার এই মন্দিরটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।

এখন কাশী বিশ্বনাথ মন্দির এমন একটি স্থান যেখানে প্রতি বছর 70 লাখেরও বেশি মানুষ যান। তবে সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিশাল পরিকল্পনা, এখানে একটি করিডোর তৈরি করা হয়েছে যার মাধ্যমে গঙ্গার তীরে মন্দির ও ললিতা ঘাটে যাওয়ার পথ ছোট ও সহজ হয়েছে।

এই মন্দিরের আগে আয়তন ছিল মাত্র 3000 বর্গফুট।  কিন্তু সংস্কার, পুনরুদ্ধার ও আপগ্রেডেশনের পর এই মন্দিরটি এখন বিস্তৃত, প্রায় ৫ লাখ বর্গফুট।  একদিনে, 2 লক্ষ ভক্ত মন্দির দর্শন করতে পারবেন। এই প্রকল্পটি 2019 সালে শুরু হয়েছিল এবং মহামারী সত্ত্বেও 3 বছরের মধ্যে শেষ হয়েছে। এটি সম্প্রতি 2022 সালের শুরুতে উদ্বোধন করা হয়।


এই শহরের গঙ্গার ঘাটকে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে আবর্তিত হচ্ছে তার জনজীবন। গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী, ধার্মিক, যোগী, পাপী, সত্যসন্ধানী সকল মানুষের নিত্য আসা-যাওয়া। পতিতোদ্ধারিনী গঙ্গায় অবগাহন করে পাপনাশ বা পূণ্য সঞ্চয়। বিচিত্র এ জগতের এক কোণে এ যেন পরমানন্দের লীলাক্ষেত্র। পূব আকাশ ক্রমশ ফর্সা হচ্ছে, শুকতারা তখনও অম্লান । গলিপথ দিয়ে গঙ্গার দিকে হেঁটে যাচ্ছেন এক বৃদ্ধ পুরোহিত । পিছন পিছন একতারা বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে বৈরাগীও চলেছে গঙ্গাস্নানে। মন্দিরে মন্দিরে পুজোর ঘণ্টা বাজছে। ঘুম থেকে জাগছে প্রাচীন বারাণসী। এই সময়টাই বারাণসীর ঘাট দেখে বেড়ানোর সবচেয়ে ভালো সময়। নৌকা নিয়ে ভেসে পড়লেই হল। হাল্কা ঢেউয়ের দোলায় নৌকা দুলতে থাকে। ধীরে-ধীরে পার হয়ে যায় একেকটি ঘাট। বারাণসীর প্রতিটি ঘাটের আলাদা-আলাদা মাহাত্ম্য আছে। আর তা থেকেই জন্ম নিয়েছে নানা গল্পগাথা। পাটনীর কাছে সেইসব শুনতে-শুনতে এগিয়ে চলা। দশাশ্বমেধ ঘাটের লাগোয়া রাণামহল ঘাট অতীত ঐতিহ্যের স্মৃতি বহন করছে। পাশেই বুজরামা প্যালেস। অনাবিল সৌন্দর্যের আকর। রাজা বুজপাল তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় রানী রমাদেবীর নামে প্রাসাদের নামকরণ করেছিলেন। হিন্দি উচ্চারণে রমা বদলে গিয়ে হয়েছে রামা। তারও আগে এটি বিহারের দ্বারভাঙার রাজার প্রাসাদ ছিল বলে জানা যায়। সংস্কারের অভাবে এখন তার ভগ্নদশা। বাঁদর, বাদুড় আর চামচিকের জমজমাট সংসার। তাও নজর কাড়ে অসংখ্য ঝরোখা। অদূরে কেদারঘাট, মাঝখানে প্রশস্ত ঢালু সবুজ ঘাসজমি। দূরে সবুজের রেখা। গঙ্গাতীরে প্রজ্জ্বলিত চিতা। হরিশ্চন্দ্র ঘাটের চিরশান্ত রূপ আত্মমগ্ন মানুষের হৃদয় কাড়ে। হনুমান ঘাট, শিবালয় ঘাট ছাড়িয়ে জৈন ঘাট। সেখানে গঙ্গাতীরে রয়েছে মনোরম স্থাপত্যকলায় সমৃদ্ধ কয়েকটা প্রাচীন জৈনমন্দির। কাছেই আনন্দময়ী মায়ের স্মৃতি বিজড়িত আরেকটি ঘাট। খানিকটা দূরে তুলসী ও অসি ঘাটের অবস্থান। অন্য দিকে মানমন্দির, প্রহ্লাদ, গাইঘাট, পঞ্চগঙ্গা ও রামঘাটের পাশাপাশি সুপ্রাচীন মন্দিরঘাট এবং মনিকর্ণিকা ঘাট দেখতে দেখতে বিষ্ময় জাগে। মন্দিরঘাটে ছোট-বড় বেশ কয়েকটা মন্দির বারাণসীর গৌরবময় অতীতের স্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মানমন্দির ঘাট বেয়ে ওপরে উঠে গেলে পৌঁছবেন মেবারের জ্যোতির্বিদ মহারাজা জয়সিংহের হাতে গড়া মানমন্দিরে। মানমন্দির অর্থাৎ যন্তরমন্তরের সূর্যঘড়ি ইত্যাদি আকাশচর্চার যন্ত্রগুলি চমৎকার। মানমন্দির ঘাটের পাশে ললিতা ঘাট। এখানকার মন্দিরটি নেপালি স্থাপত্য ও ভাষ্কর্যের অনবদ্য নিদর্শন। পাশের ঘাটের চিতাগ্নি দেখে বুঝবেন ওটা মণিকর্ণিকা ঘাট। নৌকায় ঘাটদর্শন সারা হলে চলুন বারাণসীর গলি দর্শনে। কথায় আছে ষাঁড়-সিঁড়ি-গলি-বুড়ি এই নিয়ে বারাণসীর রোজনামচা। বিশ্বনাথের গলিতে ঢুকলে বোঝা যায় কথাটা কত সত্যি। এটাই যেন মিনি ভারত ৷ দশাশ্বমেধ ঘাটের লাগোয়া এই বিশ্বনাথের গলি । গলির দুধারে রঙিন ফুলের পসররা, বেলোয়ারি চুড়ি, টিপ বিন্দি, সিঁদুর, কাঠের খেলনা, রেডিমেড পোশাক, বিখ্যাত পানমশলা ইত্যাদির দোকান। গলির শেষে বিশ্বনাথ মন্দির। বার-বার হিন্দু বিদ্বেষীদের আক্রমণে ধ্বংস হয়েছে মন্দির। খ্রিস্টিয় সপ্তদশ শতাব্দীতে দিল্লির মুঘল বাদশা ঔরঙ্গজেব প্রাচীন বিশ্বনাথ মন্দির ভেঙে · জ্ঞানবাপি মসজিদ নির্মাণ করান। তবে অষ্টাদশ শতকের সাতের দশকে ইন্দোরের মহারানী অহল্যাবাই হোলকার নতুন করে মন্দির নির্মান করেন। এরপর ঊনিশ শতকের তিনের দশকে পাঞ্জাবকেশরী রণজিৎ সিংহ বিশ্বনাথ মন্দিরের শীর্ষদেশ সোনা দিয়ে মুড়ে দেন। মন্দির থেকে কয়েক পা বাড়ালেই ঐতিহাসির মসজিদটি দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এখন সেখানে জনসাধারণের প্রহেশ নিষেধ। চারপাশে সশস্ত্র পাহারা রাজনৈতিক কারণে। সবসময় কার্বাইন হাতে টহল চলছে। পাইপ দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে সেই মসজিদ। কাছেই দেবী অন্নপূর্ণার মন্দির। মন্দিরের চত্বরটি বাঁধানো, বিগ্রহটি সোনার তৈরি।

আরও দেখার জায়গা আছে বারাণসীতে। যেমন, দুর্গা মন্দির। অতীতের পূর্ববঙ্গের অন্তর্গত নাটোরের রানী ভবানী দেবীর উদ্যোগে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় এই দুর্গা মন্দির নির্মিত হয়েছিল উত্তর ভারতীয় স্থাপত্য রীতি অনুসারে। রানী ভবানী বাংলাদেশেও বহু জায়গায় দেবালয় নির্মান করে গিয়েছেন। তার প্রতিটাই স্মরণীয় স্থাপত্য নিদর্শন। বারাণসীর দুর্গা মন্দিরও তার ব্যতিক্রম নয় । সেখানে এখন বাঁদরের রাজত্ব। ভেতরে ঢুকলেই দেখা যাবে ঘণ্টা ধরে ঝুলে রয়েছে তাদের কয়েকজন। তাই সঙ্গের শিশুদের সাবধানে রাখবেন ।

বিশ্বনাথ মন্দির ভেঙে মসজিদ গড়ার মতো আরেকটি নিদর্শন আলমগির মসজিদ। অতীতকালে এটি বিষ্ণুর মন্দির ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মাণ করিয়েছিলেন গোয়ালিয়রের মহারাজা বেণীমাধবরাও সিন্ধিয়া। বাদশা ঔরঙ্গজেবের কঠোর মনোভাবের ফলে পরবর্তীকালে দেবালয় ভেঙে দিয়ে মসজিদ তৈরি করা হয়। হিন্দু এবং মুসলিম স্থাপত্য রীতির সংমিশ্রণে তৈরি আলমগির মসজিদ বারাণসীর অন্যতম অবশ্য দ্রষ্টব্য। বারাণসীর প্রাচীন মন্দিরের ভিড়ে তার স্বকীয়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে নির্মিত তুলসীমানস মন্দির। মাত্র কয়েক দশক আগে ১৯৬৪ সালে তৈরি করার কাজ শেষ হয়েছে। শ্বেতপাথরে তৈরি মন্দিরে আরাধ্য দেবতা রামচন্দ্র। দেওয়ালজুড়ে রামচরিত মানসের ব্যাক্ষা মন্দির দর্শনে নতুন মাত্রা যোগ করে। মনে করা হয়, তুলসীদাস এখানে বসে রামচরিত মানস রচনা করেছিলেন। বারাণসী শহরে আরও দেখবেন, হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত কলাভবন, সঙ্কটমোচন মন্দির, কালভৈরব মন্দির, আনন্দময়ী মঠ ইত্যাদি। নৌকায় গঙ্গায় ভেসে ওপারে দেখে আসবেন রামনগরের রাজবাড়ি। সুন্দর গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়। রাজবাড়ির একাংশে এখন মিউজিয়াম হয়েছে। এর কাছেই ব্যাসকাশীর মন্দির। একবেলায় দেখে আসবেন সারনাথের নানা আকর্ষণীয় বৌদ্ধ নিদর্শন। বুদ্ধদেব এই সারনাথ থেকে তাঁর বাণী প্রচার করা শুরু করেছিলেন। বারাণসীর বরুণা ট্রাভেলস, ভাগ্যশ্রী ট্রাভেলস ইত্যাদি সংস্থা ছয় ঘণ্টার ট্যুরে বারাণসী, রামনগর ও সারনাথ দেখিয়ে দেয়। এইসব সংস্থার বাসে বেড়িয়ে আসতে পারবেন আরেকটু দূরের চুনার দুর্গ আর পীঠস্থান বিন্ধ্যাচল। বারাণসী থেকে চুনার দুর্গ প্রায় ৪০ কিমি দূরে গঙ্গাতীরে অবস্থানটি চমৎকার। চুনারগড়ের মহারাজা চন্দ্রকান্তা এখন বইয়ের রঙিন পাতায় জায়গা পেয়েছেন। রোমান্সে ভরা কাহিনীর গভীরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের লেখচিত্র। দুর্ভেদ্য দুর্গের প্রতিটা কক্ষে, মহলে আর পাথুরে দেওয়ালে অলৌকিক ঘটনার ঘনঘটা। ১৫৭৫ সালে মুঘল বাদশা আকবর চুনার দুর্গ অধিকার করেছিলেন। পরবর্তীকালে হাতদবদল হয়ে কেল্লার অধিকার চলে যায় অযোধ্যার নবাবের হাতে। বর্তমালে এখালে সেনাবাহিনীর দপ্তর হয়েছে। তাই ভেতরে ঢুকতে হলে বিশেষ অনুমতি দরকার হয়। যাওয়া এবং থাকা.. হাওড়া থেকে বারাণসী ট্রেনে আধ দিনের সফর। সকালের দিকে পূর্বা এক্সপ্রেস ধরলে সন্ধে নাগাদ বারাণসী পৌঁছে যাবেন। এছাড়া রাতের গাড়ি অমৃতসর মেল, দুন এক্সপ্রেস এবং হিমগিরি এক্সপ্রেস। এর কোনোটাতে গেলে পৌঁছবেন পরদিন সকালে। স্টেশন থেকে বারাণসী শহর চার কিমি দূরে। উপরোক্ত গাড়িগুলিতে কিংবা দিল্লি- কালকা মেল বা মুম্বাই মেল ভায়া এলাহাবাদে মুঘলসরাই স্টেশনে নেমেও বারাণসী যেতে পারবেন। দিনভর ট্রেকার এবং অটোরিকশা চলাচল করছে। দূরত্ব ১৬ কিমি। পর্যটকদের শহর বারাণসীতে অসংখ্য লজ ও হোটেল এবং ধর্মশালা আছে। লজ এবং হোটেলে মাঝারি মানের ডাবল বেডরুমের ভাড়া ১০০০-১৫০০ টাকা। এই মানের থাকার জায়গাগুটির ভেতরে উল্লেখযোগ্য হল.. হোটেল গ্যাঞ্জেস, দশাশ্বমেধ বোর্ডিং হাউস, লজ ভেঙ্কটেশ, লারা ইন্ডিয়া হোটেল, অলকা হোটেল, হোটেল ফারান এবং উত্তরপ্রদেশ পর্যটন পরিচালিত ট্যুরিস্ট বাংলো। খাবার হোটেল ও বারাণসীর বিখ্যাত মিষ্টির দোকানেরও অভাব নেই।