কলকাতার দূর্গা পুজা কেবল বাংলার বৃহত্তম উৎসব নয়, বরং এটি একটি বিস্ময়কর বহুমাত্রিক সংস্কৃতির পরিক্রমা—যার শিকড় ইতিহাসে আর ডালপালা ছড়িয়ে রয়েছে আধুনিকতা, শিল্প, অর্থনীতি, উৎসবমুখরতায়। এই প্রবন্ধে বিশদে তুলে ধরা হল কলকাতার দূর্গা পুজার ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থানের অনুপুঙ্খ চিত্র ।

ইতিহাস: রাজবাড়ি থেকে সর্বজনীন

কলকাতায় দূর্গা পুজার শুরু হয়েছিল প্রায় চারশো বছর আগে। সপ্তদশ শতকে রায় চৌধুরী পরিবার প্রথম দূর্গাপুজার আয়োজন করেন বারিশায়, যা কলকাতার প্রাচীনতম দুর্গা পুজা বলে ধরা হয় । ১৭৫৭ সালে শোভাবাজার রাজবাড়িতে নবকৃষ্ণ দেবের ব্যবস্থাপনায় এর নতুন দ্বার খুলে যায়—রাজবাড়ি, জমিদারদের অভিজাত আয়োজনে তখন দেবীর আরাধনা হতো কেবল ধনী পরিবারগুলিতেই । উনিশ শতকের শেষ দিকে “বারোয়ারি” বা “সর্বজনীন” পুজার সূচনা হয়। ১৯১০ সালে ভবানীপুর সনাতন ধর্মতাসহিনী সভা প্রথম সর্বজনীন দূর্গা পুজার আয়োজন করে। এই পদক্ষেপ শহরের সাধারণ মানুষকে উৎসবে সম্পৃক্ত করে, পুজাকে ব্যক্তিগত আয়োজন থেকে সামাজিক উৎসবে পরিণত করে । এই পরিবর্তনের হাত ধরে বড় বড় ক্লাব, মোহল্লা, গলি—সব জায়গায় শুরু হয় পুজার আয়োজন, দেখনদারি, মৈত্রী ও মিলনমেলা।

সাংস্কৃতিক রূপান্তর ও আধুনিক চলন

দূর্গা পুজা মূলত দেবীর দেবত্ব, শক্তি, মাতৃত্ব, কল্যাণ ও অশুভ শক্তি বিনাশের প্রতীক। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিল্প-সাহিত্য, স্থাপত্য, গান, নাটক, আলোকসজ্জা, বিজ্ঞাপন—সব জায়গার বিস্তার। বর্তমানে পাঁচ দিনের মূল আচার ছাড়াও (ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী) উৎসব সংগঠিত হয় মহালয়ার দিন থেকেই, যখন শহরের প্রতিটি গলিতে শোভাযাত্রা, আলোকসজ্জা, থিম-প্যান্ডেল, ক্রিয়েটিভ প্রদর্শনী শুরু হয়ে যায় ।

এই শিল্প-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান বিশ্ব জুড়ে স্বীকৃতি পেয়েছে, ২০২১ সালে UNESCO "Intangible Cultural Heritage of Humanity"-র তালিকায় কলকাতার দূর্গা পুজা অন্তর্ভুক্ত হয় ।

পরিবর্তনের ধারায় নতুন সংযোজন

কলকাতার দূর্গা পুজা আজ প্রায় ৩০০০ বারোয়ারি পুজা, হাজার হাজার প্রতিমা, বিশাল বাজেট, থিম-ভিত্তিক প্যান্ডেল, স্মরণীয় আলোকসজ্জা, আর অসংখ্য শিল্পীর শৈল্পিক কল্পনার মিলনে পার্বণ । বিগত শতাব্দীজুড়ে অর্থনীতিতে পুজার গুরুত্ব বেড়েছে—১৯৫৭-তে যেখানে গড় ব্যয় ছিল ৮-১২ হাজার টাকা, সেখানে ২০১২-তে মোট ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১২৩ কোটি টাকায় ।

এখনকার পুজায়—বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী, ডিজাইনার, স্থপতি, কারিগরদের হাতে শহরটা আক্ষরিক অর্থে বিশাল শিল্প-গ্যালারিতে পরিণত হয়। পুজার আর্থিক পরিধি ২০১৯ সালে ৩২ হাজার কোটি টাকা, ২০২৪ সালে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ।

জনপ্রিয় থিম ও প্রধান প্যান্ডেল

বিগত কয়েক দশকে থিম-ভিত্তিক পুজা কলকাতার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ । ভারত-বাংলার ইতিহাস, সাম্প্রতিক সমাজ-সংস্কৃতি, আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ—সব জায়গার ছোঁয়া দেওয়া হয় প্যান্ডেলের নির্মাণে। যেমন—শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাব, কলেজ স্কোয়ার, বাগবাজার, সাঁতারঘাট, এককালের রাজার বাড়ির পুজা, বড় বড় ক্লাব—এসব পুজা শহরজুড়ে ভিড়, আলো, থিম, প্রযুক্তি, পরিবেশবাদে একালেকে আগুন লাগায় ।

অর্থনৈতিক মাপকাঠি

২০১৬ সাল থেকে "Durga Puja Carnival"-এর সূচনা হয়, যেখানে পুজা শেষে শহরের কয়েকটি শ্রেষ্ঠ পার্টিসিপেন্ট কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক প্রদর্শনীতে শোভাযাত্রা করেন । বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থা যেমন Asian Paints, দুর্গা পুজার পুরস্কার দেয় 'Sharad Shamman' নামে। সরকারও ২০১৩ সালে 'Biswa Bangla Sharad Samman' প্রদান শুরু করেছে । সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতি পুজা কমিটিকে সরকার সহায়তা দিয়েছে, ২০২৫ সালে এই পরিমাণ ১ লাখ ১০ হাজার টাকায় পৌঁছেছে ।

British Council-এর সমীক্ষায় জানা গেছে, দুর্গা পুজার সময় পশ্চিমবঙ্গের GDP-র ২.৫৮% সরাসরি এই উৎসবের সঙ্গে যুক্ত । চিত্রশিল্প, মূর্তি তৈরী, আলোকসজ্জা, সাজ-গোজ, বিজ্ঞাপন, খাবার, পোশাক, বিনোদন—সব ক্ষেত্রেই, হাজার হাজার মানুষের জীবিকা দুর্গা পুজা কেন্দ্রিক ।

সমাজ-সংস্কৃতি ও ধর্মের সংমিশ্রণ

দূর্গা পুজার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য—শ্রেণি, ধর্ম, জাতিগত বিভাজন ভুলে সকল মানুষ একত্রিত হন। উৎসবের সময়ে সব গণ্ডি, সীমা, বিভেদ বিলীন হয়ে যায়। শিল্প, বাণিজ্য, সংস্কৃতি, মিলনমেলা, মৈত্রী—এইসবই দুর্গা পুজার আসল রহস্য ।

দুর্গা পুজার মূর্তিগুলো তৈরি হয় গঙ্গার মাটি দিয়ে। উৎসবের শেষ দিন, প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে, দেবীর 'ঘরে ফেরার' প্রতীকী ছোঁয়া দেওয়া হয় । একে নাড়ির টান, আত্মীয়তা, শিকড়কে স্মরণ করার উৎসব বলেও অনেকে দেখেন।

সমস্যা ও সমাধানের দিক

আধুনিক পুজার বিপুলতা ও উৎসবমুখর আহ্বানে কিছু সমাজসংশ্লিষ্ট সমস্যা দেখা দেয়—যেমন ভিড়, নিরাপত্তা, পরিবেশ, বাজেট সংক্রান্ত বিতর্ক—কিন্তু কলকাতাবাসীদের সমবেত উদ্যোগে পুজা নিরাপদ ও মনোরম রাখতে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয় ।

খনা-বিষ্ণু-নানক, কবি-চিত্রশিল্পী- স্থপতি—সবাই কলকাতার দূর্গা পুজাকে ব্যক্তি-সমাজ-শিল্প-সংস্কৃতির মেলবন্ধন বলে মনে করেন।

উপসংহার

কলকাতার দূর্গা পুজা – জনমনের শক্তি, শিল্পের উন্মেষ, সংস্কৃতির মিলন, ইতিহাসের গর্ব, আধুনিকতার শ্রেষ্ঠত্ব। শতাব্দীজুড়ে পরিবর্তন, সমাজ-সংস্কৃতির গতিপথে শহর এক চিরনবীন পরিক্রমা পেয়ে যায়। UNESCO-র স্বীকৃতির ফলে এ উৎসব আজ বিশ্ববীক্ষায় শ্রেষ্ঠ বাংলা পরিচয়। কলকাতার দূর্গা পুজা সত্যিই এক জীবন্ত সত্তা, যে সত্তা রোজ মাটির ঘ্রাণে নতুনত্ব আনে, দেবীকায়ার শক্তি-ভূমিকায় সমাজকে নিরন্তর স্পন্দিত রাখে ।