মাধব ঘোষ
জয়ন্তী বক্সা জঙ্গলের ধারে একটি ছোট সুরম্য বন গ্রাম। জয়ন্তী নদীর ধারে অবস্থিত, যা ভুটান পাহাড়ের সাথে একটি প্রাকৃতিক সীমানা তৈরি করে, নদীর পূর্ব পাশের পাহাড় এবং পশ্চিম পাশের ছোট গ্রামটির নামকরণ করা হয়েছে যথাক্রমে জয়ন্তী পাহাড় এবং জয়ন্তী গ্রাম। এর নির্মল পরিবেশ এবং সচিত্র দৃশ্যের সাথে, জয়ন্তীকে প্রায়শই "ডুয়ার্সের রানী" হিসাবে উল্লেখ করা হয়। আলিপুরদুয়ার থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার দূরে এই বনগ্রাম।
জয়ন্তী গ্রামটি ডুয়ার্স অঞ্চলের প্রাচীনতম শহরগুলির মধ্যে
একটি কিন্তু বর্তমান সময়ে আপনি শহরটিকে দেখতে পাচ্ছেন না বরং আপনি যা দেখছেন তা
একটি প্রাণবন্ত পরিবেশের মধ্যে একটি ক্ষয়প্রাপ্ত গ্রাম। প্রকৃতি এখানে সমৃদ্ধ
হয়েছে, বন সবুজ এবং বন্যপ্রাণী
প্রচুর। যদিও গভীর জঙ্গলে দেখা খুব একটা দেখা যায় না। শহরের জীবনের একঘেয়েতা
থেকে দূরে জয়ন্তীর একটি ভ্রমণ হল একটি আদর্শ অবসর ছুটির গন্তব্য যেখানে সময় তার
দ্রুত গতি কমিয়ে দিয়েছে বলে মনে হয়। দ্রুত প্রবাহিত জয়ন্তী নদীর সঙ্গীত, অজানা পাখির কিচিরমিচির, প্রকৃতির মিষ্টি সুবাস
এবং জয়ন্তীর সতেজ শীতল বাতাস আপনাকে সম্পূর্ণরূপে চাঙ্গা করে তুলবে। যদিও নদীটি
বছরের বেশির ভাগ সময় শুষ্ক থাকে তার চারপাশে নুড়ি পাথরের সাদা বিছানা স্থানটিকে
একটি অতুলনীয় সৌন্দর্য প্রদান করে। ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে জয়ন্তী যাওয়ার পথ
বাক্সা টাইগার রিজার্ভ টাইগার রিজার্ভ একটি আকর্ষণীয় অভিজ্ঞতা এবং জয়ন্তী সফরের
আরেকটি বিশাল আকর্ষণ। হাতির পাল বা দাগযুক্ত হরিণ বা প্রচুর ময়ূরের দেখা জয়ন্তীর
পথে সবচেয়ে সাধারণ দর্শনীয় স্থান। জয়ন্তীর কাছাকাছি একটি পোখরি রয়েছে যা
স্থানীয় লোকজন ভয় পায় বলে মনে করে পোখরির জলে বিপুল সংখ্যক মাগুর এবং কচ্ছপ
দেখার জন্য একটি দুর্দান্ত জায়গা এবং এই স্থানের সৌন্দর্যে অবশ্যই এমন কিছু
রয়েছে যা একটি সতেজ করে তোলে। প্রভাব মহাকাল গুহা হল আরেকটি আকর্ষণীয় স্থান
যেখানে আপনি যেতে পারেন ভুটান সীমান্তের কাছে অবস্থিত এই গুহা মন্দিরটি ভগবান
শিবকে উত্সর্গীকৃত এবং মহা শিবরাত্রির সময় অনেক দর্শনার্থী এই গুহাটিতে যান।
জয়ন্তী থেকে মাত্র ৪.৫ কি.মি দূরত্ব। বড় মহাকাল গুহাটি উত্তরের ছোটো অমরনাথ বলেই পরিচিত। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে এর উচ্চতা অনুমানিক ২৭০০ ফিট।প্রকৃতির মাঝে দুপাশে পাহাড়ের বুক চিঁড়ে চলতে থাকা খরস্রোতা জয়ন্তী নদী পাশ দিয়ে।নানান রকমারী গাছ -গাছালী ও ফুটে থাকা বনজ ফুলে আকৃষ্ট হয়ে উঠবে চোখ।ঠান্ডা হিমেল বাতাসের অনূভুতিতে চরম সন্তুষ্টি খুঁজে পাবে হৃদয়। পাহাড়ে দূরের কোনো এক মগডাল থেকে বাতাসে ভেসে আসা অচেনা মিষ্টি পাখির ডাক পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে কান ছুঁয়ে যায় অবিরাম। আর নদীবক্ষে উড়তে থাকা ঝাঁক ঝাঁক রঙিন প্রজাপতি রাঙিয়ে দিয়েছে পবিত্র দেওভূমিকে । এই মহাকাল গুহা পাখি ও প্রজাপতির স্বর্গরাজ্য বলেই পরিচিত।
শিব চতুর্দশীতে এখানে পুণ্যার্থীদের প্রচুর ঢল নামে।ভক্তদের সেবায় পূর্ণলাভের আশায় এখানে বসে প্রচুর ভান্ডারা।বড় মহাকাল গুহায় যেতে প্রত্যেক বছর জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারী
মাস থেকে রাস্তা বানানো শুরু হয়।বড় বড় দৈত্যাকার পাথরের উপর দিয়েই পথ চলা। এই
গুহার মুখে জোড়া পাহাড় নামক স্থানে উঁচু উঁচু কাঠের মই এবং গভীর নদীর
জলের উপরে বাঁশের সাঁকোর পথ বেয়েই পৌঁছাতে হয় বড় মহাকাল গুহায়
প্রবেশদ্বারে। পাহাড়ি খরস্রোতা নদীর জল দৈত্যাকার পাথরগুলিতে আঁছড়ে পড়ছে এবং সেখানে তৈরী হওয়া শুভ্র স্বচ্ছ ফেনারাশি ও জলের স্রোতের আওয়াজে
চারিপাশে এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। এই পথটি ভিষণ রোমাঞ্চকর হলেও কিছুটা ভয়ঙ্কর বটে,
যেটা
এই পথে বেড়াতে আসা প্রত্যেকের মন জয়
করতে সক্ষম।অনেকটা পথ কাঠের মই বেয়ে চড়তে হয় দৈত্যাকার পাথরের মাথায় আবার সেই পাথর
গুলির নিচে কোঠরের থেকে কিছুটা পথ অতিক্রম করতে হয় মাঝে মাঝে। কোথাও কোথাও জলে
ভিজে পিচ্ছিল হয়ে থাকা নদীর উপরে বিছিয়ে রাখা পাতলা গাছের সাঁকোয় পা দাবিয়ে পারা পার করতে হয়।চড়াই ও
উতরাই এর মধ্য দিয়ে পৌঁছাতে হয় বড় মহাকাল গুহার প্রবেশদ্বারে সামনে।
মে মাসের পরে কোনো এক দিনের পাহাড়ের অতিভারী বৃষ্টির ফলে নদীর জলের স্রোতে বাঁশের
সাঁকো ভেসে এবং মইগুলি ভেঙে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় এই রোমাঞ্চকর পথটি। বড়
মহাকাল গুহায় ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্তই যাওয়া যায় এটাই মনোরম সময়। বড়
মহাকালের পথটি পাহাড়ি ও পুরোটাই চড়াই।পাহাড়ের ঢাল কেটে বানানো সরু পাতলা পাগডন্ডি।আর সুরক্ষার
জন্য কোথাও আবার পাহাড়ের গায়ে লাগানো আছে লোহার তার, যা আপনাকে এই ভয়ংকর পথের
সাহারা হয়ে দাঁড়াবে। সরু পথে পাহাড়ের গায়ে অনেক জায়গায় রয়েছে শুধু পা রাখবার মতো
খাঁড়া সিমেন্টর সিঁড়ি আর পাহাড়
গায়ে বেঁধে রাখা লোহার তার, এর একপাশে ভয়ংকর পাহাড়ের খাদ্।এই ভাবে
ছোট ছোট কদমে পৌঁছাতে হয় মহাকাল বাবার দরবারে।
গুহার মুখে ১৫-২০ ফুটের লোহার মই বেঁয়ে উঠতে হয় এই গুহায়।
লোহার সিঁড়ি গুলি মোটামোটা লোহার শিকলে বাঁধা থাকে।
আপনাদের জানিয়ে রাখি এই পাহাড়ে কোনো মহাকাল শিবের কংক্রিটের বানানো মন্দির নেই
পুরোটাই স্ট্যালাগটাইট -স্ট্যালাগমাইট এর তৈরি প্রাকৃতিক কয়েকটি গুহা। আর এগুলি স্ট্যালাকটাইট
- স্ট্যালাগমাইট নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন আকৃতির সুন্দর সুন্দর গুহার ডিজাইনে
আকৃষ্ট হয়ে ওঠবে হৃদয়,
প্রকৃতির
নিজ হাতে তৈরী অনবদ্য নিদর্শনের তাজা উদাহরণ। হিন্দু সম্প্রদায়ের আস্থা ও
ভগবান মহাকাল বাবার নামের বিশ্বাসের মধ্যে দিয়েই এই কঠিন ভয়ংকর পথকে পিছনে ফেলে
এখানে জমা হয় লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থী ।
0 Comments