অন্তরা ঘোষ

ছত্রিশগড় রাজ্যটিকে প্রকৃতি যেমন অকৃপন ভাবে তার অনির্বাচনীয় রূপ রাশি দিয়ে সাজিয়ে তুলেছে তেমনি এই রাজ্যটির স্থাপত্য শিল্পকলা এবং  প্রাচীন ঐতিহাসিক  গড়িমাও কিন্তু পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। বলা হয়ে থাকে কোন এক সময় এখানে ৩৬ টা গড় বা দুর্গ অথবা কিলা ছিল। তাই এর নাম হয়েছিল ছত্রিশগড়।প্রাচীন ভারতের দক্ষিণ কোশল জনপদের কিছুটা অংশ পরে ছত্রিশগড়ে। দক্ষিণ কোশলের বিভিন্ন রাজবংশ যেমন শরভপুরী, পান্ডু বংশী ইত্যাদি রাজবংশের রাজারা  এখানে রাজত্ব করেছিলেন। এখানে বৌদ্ধ জৈন শৈব শাক্ত ইত্যাদি বিভিন্ন মত ও ধর্মাবলম্বীর মানুষ বিভিন্ন সময়ে এসেছিলেন।
আমি ছত্রিশগড়ের রাজধানী রায়পুরে অনেকদিন থেকেই বসবাস করি। লোকমুখে শুনি যে রায়পুর থেকে প্রায় ৯০-৯৫ কিলোমিটার দূরে বিলাসপুর জেলায় আমেরি কাঁপা গ্রামের কাছে তালাগাঁও বা  তালাগ্রাম বলে একটি স্থান আছে যেখানে  পঞ্চম /ষষ্ঠ শতাব্দীর বহু মূর্তি ও মন্দিরের ভগ্নাবশেষ মাটির তলা থেকে উঠে এসেছে। একটা অদ্ভুত মূর্তির কথা শুনলাম যা আমার যাওয়ার আগ্রহকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিল।একটি ৯ ফিট উচ্চতা ও ৫ ফুট চওড়া, পাঁচ টন ওজনের অদ্ভুত দর্শন মূর্তি পুরাতাত্ত্বিক খনন কার্যের ফলে উঠে এসেছে যার শরীরের অংশবিশেষ নাকি বিভিন্ন পশু প্রাণী কীটপতঙ্গ দিয়ে তৈরি। স্থানীয় মানুষেরা এই মূর্তির নাম দিয়েছে রুদ্রশিবের মূর্তি। এই মূর্তিটি আনুমানিক পঞ্চম শতাব্দীর এবং  এইরকম অদ্ভুত দর্শন মূর্তি পৃথিবীতে এক এবং অদ্বিতীয়। তবে স্থানীয় মানুষেরা এই মূর্তিকে রুদ্র শিবের মূর্তি বললেও বর্তমান পুরাতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকরা মূর্তিটির উপর গবেষণা করে এই মূর্তিটিকে কালপুরুষ আখ্যা দিয়েছেন। এই কালপুরুষকে স্বচক্ষে দেখার জন্য আমি বেশ উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলাম। হঠাৎই সুযোগ এসে গেল। আমরা পিকনিক করতে গেলাম রায়পুর থেকে তালাগাঁও। শিবনাথ নদীর সহায়ক নদী মনিয়ারী নদীর তীরে অবস্থিত সিদ্ধনাথ আশ্রম ও ও আশ্রম পরিসরের ভেতরে ঢুকে কিছুটা যেতেই মনিয়ারি নদীর ধারে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই রয়েছে মন্দির প্রাঙ্গণ এবং চারদিকে বেশ কিছু মন্দির। রয়েছে সিদ্ধনাথ অর্থাৎ মহাদেবের মন্দিররাধাকৃষ্ণর মন্দির, শিব পার্বতীর মন্দির,রাম সীতার মন্দির, স্বামী পূর্ণানন্দ মহারাজ মন্দির ও গোশালা ইত্যাদি। এই সমস্ত মন্দির দর্শন করার পর রাম লক্ষণ সীতার মন্দিরের পাশ দিয়ে  গিয়ে একটা ছোট্ট গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে সেই বিখ্যাত দেবরানী জেঠানী মন্দির এর কাছে এলাম। একদিকে দেবরানী মন্দির অন্যদিকে জেঠানী। দেবরানী মন্দিরের তবুও কিছুটা অস্তিত্ব আছে কিন্তু জেঠানী মন্দিরে অর্ধভগ্ন মূর্তি চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, মন্দিরের ভগ্নাবশেষ দেখতে পাচ্ছি।
দেবরানী মন্দির এর স্থাপত্য কলা, পাথরের গায়ে খোদাই করা নকশা, পাথর কেটে কেটে তৈরি বিভিন্ন মূর্তি দেখে বিস্ময়িবিষ্ট হলাম। প্রায় ১৬০০/১৭০০ বছর আগে মানুষের শৈল্পিক চেতনা, সুনিপুন স্থাপত্য কলা দেখে বিমোহিত হতেই হয়। প্রাচীন এই দুই মন্দিরের খোঁজ সর্বপ্রথম দেন ১৮৭৩-৭৪ সালে জে ডি ব্যাগলার নামে একজন পুরাতত্ত্ববিদ। মহানির্দেশক আলেকজান্ডার কর্নিঘাম এর সহযোগী ব্যাগলার কে তালাগাঁও এর সন্ধান দেন তৎকালীন কমিশনার ফিসার। দেবরানী জেঠানী মন্দিরের ইতিহাস ও স্থাপত্য শিল্পের আলোচনা অন্যদিন করব কেননা আজ আমি শুধু কালপুরুষকে নিয়ে বলতে বসেছি। তবে তার আগে ছোট্ট করে একটু তালাগাঁও এর ইতিহাসটা বলে দি।
তালাগ্রাম ছিল গুপ্ত যুগে এবং গুপ্তোত্তর যুগে প্রসিদ্ধ ও সমৃদ্ধশালী গ্রাম। দক্ষিণ কোশল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল এই গ্রাম। গুপ্তদের অধীনে সামন্ত রাজা ছিল শরভপুরী রাজারা। এরা ছত্রিশগড়ের রায়পুর ,রতনপুর, শ্রীপুর (সিরপুর) এ রাজত্ব করতো। মনিয়ারী নদীর তীরে এই দুই মন্দির পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতকে শরভপুরী রাজারা নির্মাণ করেছিলে।  অনুমান করা হয় রাজার দুই রানী এই দুই মন্দিরে পুজো দিতে আসতেন।  স্থানীয় গ্রামীণ লোকেরা তাই এই দুই মন্দিরের নাম দিয়েছিল দেবরানী ও জেঠানী মন্দির। তবে শিব মন্দির ছিল এমন কোন প্রামাণ্য তথ্য নেই। অনেক ইতিহাসবিদের মতে এই জায়গাটি ছিল তন্ত্রসাধনার কেন্দ্র। তন্ত্রসাধনা অর্থাৎ শিব ও শক্তির আরাধনা।জেঠানী মন্দির টিকে মনে করা হয় পার্বতীর আরেক রূপ তারা মায়ের মন্দির। এখানে শক্তির আরাধনা হতো। তারা মায়ের মন্দির থেকে এই জায়গার নাম ছিল  তারাগাঁও ।  তারা শব্দের অপভ্রংশ হতে হতে পরবর্তীতে নাম হয়ে গেছে তালাগাঁও।
চলুন এবার আমরা শিবের আরেক অবতার রুদ্রশিবের মূর্তি দেখি । এই অদ্ভুত মূর্তি নাকি পৃথিবীতে এই একটাই আছে। দেবরানী মন্দিরের ঠিক পাশেই ছোট্ট ঘর করে  দেওয়া হয়েছে।লোহার রেলিং দেওয়া গেট তালা দেওয়া আছে।এই ঘরেই রাখা হয়েছে এই অদ্ভুত দর্শন মূর্তিকে। মূর্তির দিকে তাকিয়ে রইলাম অভিভূত হয়ে। মূর্তিটির শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ কোন পশুপাখি বা পোকামাকড় অথবা মানব মুখ দিয়ে তৈরি। যিনি গাইড ছিলেন তিনি অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখাচ্ছিলেন যে শরীরের কোন অংশ কোন প্রাণীর মতো। এই  অদ্ভুত মূর্তিটি দেখতে দেখতে ভাবছিলাম যে  এত বছর আগে ভারী পাথর কেটে কেটে কিভাবে এত নিখুঁতভাবে স্থাপত্যকাররা বানিয়েছিলেন এই মূর্তি তা ভেবে সত্যি আশ্চর্য হতে হয়।
যদিও এখানকার মানুষেরা বলছেন এটা রুদ্র শিবের অর্থাৎ শিবেরই এক অবতার রূপের বিগ্রহ কিন্তু বর্তমান ঐতিহাসিক, জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ ও পুরাতত্ত্ববিদরা কিন্তু অন্য কথা বলছেন। তাদের অনেকেরই বক্তব্য যে  এই মূর্তিটির সাথে বারোটি রাশি সম্পর্কিত।ইউরোপ, আমেরিকা ,কানাডা, গ্রেট ব্রিটেন ,ফ্রান্স প্রভৃতি বিভিন্ন স্থান থেকে স্কলার ও গবেষকরা এই তালাগ্রামে এসে  এই মূর্তির উপর গবেষণা করে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন। আমেরিকান জ্যোতিষবিদরা এই মূর্তির মধ্যে ত্রয়োদশ রাশিরও খোঁজ পান যার খোঁজ তারা অনেক দিন ধরে করছিলেন।
ছত্রিশগড়ের রাজধানী রায়পুরের পুরাতত্ত্ব বিভাগের বিশেষজ্ঞ ডক্টর হেমু যদু স্যার ১৯৯৯ কে এই মূর্তির ওপর গবেষণা শুরু করেন ও মূর্তিটির নাম দেন কালপুরুষ অর্থাৎ যে কালকে জয় করে অজেয় হয়ে আছে। ডক্টর হেমুর মতে পুরো বিগ্রহটি আসলে জ্যোতিষ শাস্ত্রের বারোটি রাশি। যিনি মূর্তিটি বানিয়েছিলেন তার গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কে  যথেষ্ঠ জ্ঞান ছিল। পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতকে  জ্যোতিষশাস্ত্রের চর্চা হতো।নালন্দা, তক্ষশীলা ,বিক্রমশিলা ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জ্যোতিষ বিষয়ে পড়ানো হতো। তাই কাল বা সময় কে জয় করার জন্য এবং মানুষকে তার রাশি সম্পর্কে অবহিত করার জন্য সম্ভবত এই মূর্তি বানানো হয়েছিল। মূর্তিটির মাথায় সাত জড়ানো পাগড়ী রয়েছে, দুই কান ময়ূর আকৃতির, মূর্তিটির চক্ষু  ব্যাঙের মতো যা মেষ রাশির প্রতীক, নাক বিছের মতো অর্থাৎ বৃশ্চিক রাশির প্রতীকমোচ মাছের আকৃতির মীন রাশির প্রতীক, কাঁকড়া আকৃতির থুতনি কর্কট রাশির প্রতীক, কুমির আকৃতির বাহু মকর রাশির প্রতীক, জঙ্ঘা তে স্ত্রী পুরুষ যুগল মূর্তি মিথুন রাশির প্রতীক, কুম্ভকার আকৃতির পেট কুম্ভ রাশির প্রতীক, জঙ্ঘা তে কন্যার মুখ কন্যা রাশির প্রতীক, কোমরের নিচের অংশ থেকে জঙ্ঘা পর্যন্ত দুপাশের মানবমুখ ও মাঝখানে কচ্ছপ আকৃতির দন্ড যা তুলা রাশির প্রতীক, হাঁটুতে সিংহের মুখ সিংহ রাশির প্রতীক, একদম নিচে বাঁ দিকে পায়ের কাছে ধনুরাকৃতি শোয়ানো সাপ ধনু রাশির প্রতীক। এইভাবে বারোটা রাশি বিগ্রহটিতে দেখানো হয়েছে। সম্প্রতি আরো একটা রাশির খোঁজ পেয়েছেন আমেরিকান বৈজ্ঞানিকরা। মূর্তিটির মাথার পেছনে রয়েছে সর্পশীর্ষ বা সাপের ফনা আকৃতি। এটাই নাকি ত্রয়োদশ রাশি।
মনে মনে ভাবলাম যে আমেরিকার জ্যোতিষশাস্ত্রবিধরা যে ত্রয়োদশ রাশির খোঁজ করছেন তা কিনা আনুমানিক প্রায় ১৭০০ বছর আগে এই তালাগ্রামে কালপুরুষ নামক এই বিগ্রহের মধ্যে দেখানো হয়ে গিয়েছিল। এর থেকে প্রমাণিত তখনকার দিনে  স্থাপত্যকলা, জ্যোতিষশাস্ত্র ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানুষের সম্যক জ্ঞান ছিল। গুপ্তযুগকে তো আমরা জানি সুবর্ণ যুগ বলা হত তার কারণ শিল্প সংস্কৃতি কলা জ্যোতিষশাস্ত্র ব্যবসা-বাণিজ্য সব দিক দিয়ে গুপ্ত যুগ সমৃদ্ধির শিখরে ছিল। এই সমৃদ্ধির কিছুটা নমুনা দেখলাম আমার সামনে দাঁড়ানো কালপুরুষের মূর্তির মধ্যে।
কালপুরুষকে দেখতে দেখতে কালচক্রযানের মাধ্যমে আমিও হয়তো  কিছুক্ষণের জন্য ফিরে গিয়েছিলাম সুদূর অতীতে ,প্রাচীন যুগে। এমন বিরল মূর্তি যা নাকি পৃথিবীতে এই একটাই তাকে দর্শন করে এবং মূর্তিটির বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব জেনে কৌতুহলী মন তৃপ্ত হলো। কালপুরুষের মূর্তি মনের ক্যানভাসে আঁকা হয়ে থাকল যা কোনদিনও মুছে যাওয়ার নয়।