Kashmir এখন কাশ্মীর
অন্তরা ঘোষসেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি আমাদের দেশে একটা স্বর্গ আছে যার নাকি আদরের নাম ভূস্বর্গ! গত পুজোর সময় আমরা গেছিলাম ভূ-স্বর্গ কাশ্মীরে। জম্বু তাওয়াই ধরে কাটরা স্টেশনে নেমে বৈষ্ণোদেবী দর্শন করে আমরা পরদিন গেলাম পহেলগাঁও। পৌঁছেই বুঝলাম কেন একে ভূস্বর্গ বলা হয় । অবাক হলাম এটা ভেবে যে এই নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা স্থান নিয়ে কী করে মানুষের মনে লড়াই আসে! এই জায়গার অধিকার একমাত্র ঈশ্বরের আছে , উপরওয়ালা ছাড়া এই জায়গার মালিক আর কেউ হতে পারেনা।পহেলগাঁও ছবির মতো সাজানো একটা ছোট্ট শহর .. যেদিকে চোখ যায় প্রকৃতির অনন্ত রূপ রাশি চোখে পড়বে। সন্ধ্যে নাগাদ পৌছে আমরা আগে থেকে বুক করে রাখা হোটেলে গিয়ে সেদিন বিশ্রাম নিলাম । ইনোভা গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম আরু ভ্যালি ও বেতাব ভ্যালির মনমুগ্ধকর সৌন্দর্য আস্বাদন করতে। ইনোভা গাড়িতে আমরা দুটো ফ্যামিলি বসে রওনা দিলাম আরু ভ্যালির দিকে। পহেলগাঁও থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে আরু ভ্যালি। যাওয়ার পথটুকু রাস্তার দু দিকে প্রকৃতি যেন সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। কোথাও পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা উইলো পাইন পপুলার এর সবুজ অরণ্য, কোথাও নৃত্যরতা পাহাড়ি নদী, কোথাও আবার পাহাড়ের একদিকে রোদ্দুর তো অন্যদিকে মেঘ.. যেন একে অন্যের সাথে লুকোচুরি খেলছে।বারবার গাড়ি থামিয়ে এই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ফটো নেওয়া থেকে নিজেকে কিছুতেই বিরত করতে পারছিনা।আরু ভ্যালি আসলে একটি পাহাড়ি গ্রাম। ছবির মতো সুন্দর এই গ্রামের মনমুগ্ধকর সৌন্দর্য দেখতে পর্যটকরা বারবার আসেন। নির্জন শান্ত পরিবেশে আরু ভ্যালির অনির্বচনীয় নজরকাড়া সৌন্দর্য পর্যটকদের বিমোহিত করে। যতদূর চোখ যায় পর্বতশ্রেণীগুলি যেন সবুজ পাড় সাদা শাড়ির আঁচল বিছিয়ে রয়েছে। যেহেতু কাল সারাদিন স্নোফল হয়েছে তাই শৃঙ্গ রাজি বরফের আচ্ছাদনে আবৃত। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ছোট ছোট গ্রাম্য কটেজ। এক জায়গায় পাহাড়ি ঝরনা চঞ্চল কিশোরী মেয়ের মত নেচে নেচে বয়ে চলেছে। প্রায় আকাশছোঁয়া পাইন ফার, উইলো, দেবদারু গাছের পাতা থেকে টুপ টুপ করে ঝরে পড়ছে বরফের কুচি।আরু ভ্যালিতে টাট্টু ঘোড়া বা পনি করে উপরের দিকে উঠলে সেখানে তিন-চারটি পয়েন্ট আছে এবং ট্র্যাকিং ও করা যায়। ড্রাইভার জানালো যে এখানে বজরঙ্গি ভাইজান, হিরো , যব তক হ্যায় জান, রকস্টার, হায়দার ইত্যাদি অনেক সিনেমার শুটিং হয়েছে। আরুভ্যালি থেকে আমরা এবার রওনা দিলাম বেতাব ভ্যালির দিকে। ১৯৮৩ সালের জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা বেতাবের শুটিং এই বেতাব ভ্যালিতে হয়েছিল বলে এই ভ্যালির নামকরণ হয়েছে বেতাব ভ্যালি। চারিদিক বরফে ঢাকা একের গায়ে আরেক পর্বতশ্রেণী.. দূরের দুধসাদা আলোয়ান পড়া পাহাড়গুলোতে সকালের সূর্যের নরম আলো পড়ে অপরূপ মোহময়ী করে তুলেছে, সোনালী আলোর আভা ছড়িয়ে পড়েছে উপত্যকায়।পর্বতের খাঁজে খাঁজে মেঘ বালিকার অবাধ আনাগোনা. গোটা উপত্যকাকে বেষ্টন করে বয়ে চলেছে লিডার নদী। স্বচ্ছ জল পাহাড়ি পাথরের ওপর আছড়ে পড়ে কলকল শব্দে সুরের মূর্ছনা তুলে বয়ে চলেছে।বেতাব ভ্যালির অদূরে পাহাড়ের গায়ে গায়ে কিছু ছোট ছোট কুটির টাইপের ঘর দেখালো ড্রাইভার। বলল এটা নাকি ওর গ্রাম এবং অমরনাথ যাওয়ার পথে এটাই শেষ গ্রাম। এই গ্রামের পাশ দিয়ে রাস্তা চন্দনবাড়ির দিকে চলে গেছে। সুন্দর সাজানো পার্ক, নরম সবুজ ঘাসের গালিচা উপত্যকা জুড়ে।পাহাড়ের গায়ে গায়ে উঁচু মাথার সারি সারি পাইন দেবদারু উইলো,চিনার, পপলার গাছ মাথা দুলিয়ে যেন আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। পাহাড়ি উপত্যকার এই পাগল করা সৌন্দর্য দেখে কিছুক্ষণের জন্য নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেলাম। প্রকৃতির ক্যানভাসে এক অসাধারণ পেইন্টিং বেতাব ভ্যালি।ড্রাইভার জানালো এখানেও কিছু কিছু জায়গায় বজরঙ্গি ভাইজান এর শুটিং হয়েছে। সেই শুটিংয়ের জায়গাটিকে বলা হচ্ছে বজরঙ্গি ভাইজান পয়েন্ট। বেতাব সিনেমার যেখানে শুটিং হয়েছিল সেই বেতাব হাউজ এবং পাশের সিঁড়িটাও রয়েছে। এখানে স্থানীয় অধিবাসীরা পিকনিক করতে আসেন। বেতাব ভ্যালিতে ঘুরতে ঘুরতে ছোটখাটো খাবারের দোকান দেখতে পেলাম। সেখানে বসে কফি এবং গরম গরম ম্যাগি খেলাম। পাহাড়ি অঞ্চলে ঠান্ডার মধ্যে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ম্যাগি কিন্তু অসাধারণ লাগে। বেতাব ভ্যালিতে অনেক গ্লেসিয়ার ও ট্রাকিং পয়েন্ট রয়েছে।তরসর লেকের বেসক্যাম্প এখানেই। কিন্তু আমাদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হোটেলে ফিরে চেক আউট করতে হবে তাই আমরা আর অত দূরে যাই নি। ড্রাইভার এর কাছে জানলাম যে এখানে লিডার নদীতে ট্রাউট ফিশ(trout fish) বলে একটা মাছ পাওয়া যায় যার দাম বেশ চড়া ।মোটামুটি..৮০০ টাকা কিলো। বুঝলাম এই মাছ হচ্ছে এখানকার পাহাড়ি মানুষদের কাছে ইলিশ মাছ। এই মাছ খেতে ও নাকি খুব টেস্টি হয়।বেতাব ভ্যালি থেকে আমরা এবার রওনা দিলাম আমাদের শেষ গন্তব্য স্থল চন্দনবাড়ির দিকে । বেতাব ভ্যালি থেকে চন্দন বাড়ির দূরত্ব মাত্র সাত কিলোমিটার। মুগ্ধ হয়ে পথের দুধারে সিনিক বিউটি দেখতে দেখতে কখন যে চন্দনবাড়ি এসে গেলো টেরই পেলাম না।চন্দনবাড়ি হচ্ছে সেই জায়গা যেখান থেকে অমরনাথ যাত্রা শুরু হয়। শ্রাবণ মাসে অর্থাৎ জুলাই-আগস্টে এখানে হাজার হাজার তীর্থযাত্রীরা আসেন অমরনাথ যাত্রা করতে। কিছুটা হেঁটে এগিয়ে গেলে ওপরে ওঠার রাস্তা পাওয়া যাবে। একদিকে কল কল করে নেচে নেচে বয়ে চলেছে লিডার নদী অন্যদিকে দূরে বরফে মোড়া পাহাড়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯৫০০ ফিট উঁচুতে অবস্থিত ও বিভিন্ন পাহাড়ি নদীর সঙ্গমস্থল হল এই ঘাঁটি যাকে বলা হচ্ছে চন্দনবাড়ি। বলা হয়ে থাকে দেবাদিদেব মহাদেব অমরনাথ গুহা যাত্রার সময় নিজের মস্তকের চন্দন এই স্থানে রেখে গিয়েছিলেন। পাহাড় থেকে নির্গত জলধারা চন্দনের সাথে মিশে ছোট নদীর রূপ ধারণ করে। এই নদী পার হয়েই অমরনাথ যাত্রা করতে হবে। এখান থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে রয়েছে শেষনাগ ঝিল। শেষনাগ ঝিলের চারপাশে রয়েছে তুষারশুভ্র শৃঙ্গ। এই ঝিলের স্বচ্ছ পান্নাসবুজ জলধারা ও চারপাশের পাহাড়ি সৌন্দর্য এই ঝিলকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে পর্যটকদের কাছে। বলা হয়ে থাকে অমরনাথ গুহা যাওয়ার পথে মহাদেব এখানে তার গলার সাপ শেষনাগকে ছেড়ে গেছিলেন। তাই এই ঝিলের নাম শেষনাগ এবং চারপাশের পাহাড়ের নাম শেষনাগ পর্বত।মনের ফ্রেমে স্বর্গীয় সৌন্দর্যের টুকরো-টুকরো ছবির কোলাজ পেস্ট করে রাখলাম যাতে মন চাইলে চোখ বুজে সেই নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে দেখতে পাই, অনুভব করতে পারি।