অন্তরা ঘোষ
 
 
প্রতিদিন শহরতলির জনসমুদ্র,কোলাহল, যানজটে কি আপনি হাঁপিয়ে উঠেছেন! খুব ইচ্ছে করছে কি একটা নির্জন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা পাহাড়ি জায়গায় দু চার দিন নিজের মত করে কাটাতে! দার্জিলিং, গ্যাংটক, সিমলা, কুলু মানালি আমরা প্রায়ই গিয়ে থাকি। ধরুন এই জায়গাটা যদি একটু অন্যরকম হয়। আদিবাসী অধ্যুষিত পাহাড়ি জায়গা যেখানে নদী পাহাড় ঝর্ণা সবুজ বনের সহাবস্থান। আর আছে বৌদ্ধ মনেস্ট্রি যেখানে গেলে মন আপনা আপনি শান্ত সমাহিত হয়ে যায়।মনে পড়ছে নিশ্চয়ই মান্না দের গাওয়া সেই বিখ্যাত গানটা! "এই শহর থেকে আরও অনেক দূরে চলো কোথাও চলে যাই"...তাহলে চলুন আমরা ঘুরে আসি ছত্রিশগড়ের একমাত্র শৈলশহর ম্যানপাটে। ছত্রিশগড়ের শৈলশহর ম্যানপাট, যাকে বলা হয় ছত্রিশগড়ের সিমলা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ম্যানপাটের উচ্চতা ১০৯৯ মিটার। অম্বিকাপুর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার মত দূরত্ব ম্যানপাটের। গভীর জঙ্গল , সবুজ উপত্যকা, মনমুগ্ধকর জলপ্রপাত , ঠান্ডা কুয়াশাভরা আবহাওয়া এই ছোট্ট পাহাড়ি শহরটিকে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু করে তুলেছে। 

এখানে দর্শনীয় স্থান গুলি হল - 

তিব্বতি ক্যাম্প ও বৌদ্ধ মনাস্ট্রি :-১৯৬২-৬৩ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের পর ওই সময়কার ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী জহরলাল নেহেরু বহু তিব্বতিয়ান শরণার্থীকে ভারতের বেশ কিছু পাহাড়ি এলাকায় যেখানে ঠান্ডা বেশি সেই সব জায়গায় আশ্রয় দেন। ওই সময় ছত্রিশগড়ের ম্যানপাটে বহু তিব্বতি শরণার্থীকে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। আজ প্রায় ৬০ বছর পরেও তিব্বতীরা তাদের নিজস্ব ধর্ম সংস্কৃতি প্রথা রীতিনীতি অক্ষুন্ন রেখে ম্যানপাটে বসবাস করছে।ম্যানপাটে প্রায় ৭/৮ জায়গায় তিব্বতি ক্যাম্প ও বৌদ্ধ মনেস্ট্রি আছে। তিব্বতি শরণার্থীদের জীবনশৈলী পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। রংবেরঙের ছোট-বড় ঝাণ্ডার সমাহার, হাতে মালা, মুখে নির্মল হাসি, চোখে শিশুর সারল্য চিনিয়ে দেয় ম্যানপাটে বসবাসকারী তিব্বতীদের। বৌদ্ধ মন্দির ও স্তম্ভের কারুকার্য মনে করিয়ে দেয় তিব্বত চীন এবং অন্যান্য বৌদ্ধ শহরের স্থাপত্য ভাস্কর্য কে। দু-তিনটি মনাস্ট্রি খুবই বিখ্যাত। এখানকার একটা বিখ্যাত মনাস্ট্রির নাম হল ধাকপো শিদুপলিং মনেস্ট্রি ( Dhakpo Shedupling Monastery) । সবথেকে বেশি পর্যটক এই মনাস্ট্রি দর্শন করতে আসেন। এই মনেস্ট্রির মধ্যে তিব্বতি বাচ্চাদের স্কুল ও আছে। দেওয়ালে, ছাদে, পিলারে ইন্দোচীন সংমিশ্রণে স্থাপত্যশৈলী পর্যটকদের মুগ্ধ করবে। ভগবান বুদ্ধের টেরাকোটার মূর্তি অতীব সুন্দর। আর আছে প্রেয়ার হুইল বা ধর্মচক্র। এই প্রেয়ার হুইল ঘুরিয়ে পর্যটকরা পূর্ণ অর্জন করেন। মনাস্ট্রি গুলিতে এক অদ্ভুত শান্তির পরিবেশ। স্থানীয় তিব্বতীদের সাথে কথা বলে জানা গেল যে তাদের বাবা ঠাকুরদারা প্রায় আড়াই তিন মাস পায়ে হেঁটে রোদ গরম বহু কষ্ট সহ্য করে গুহাতে আশ্রয় নিয়ে অবশেষে ম্যানপাটে এসে পৌঁছেছিল। ক্যাম্পগুলিতে তাদের নিজস্ব ভাষায় তিব্বতি বাচ্চাদের শিক্ষা দেওয়া হয়।তাছাড়া বুদ্ধের উপদেশ প্রার্থনা সংগীত ও ধর্মীয় শিক্ষাও দেওয়া হয়। এই বৌদ্ধ মনাস্ট্রি গুলিতে বেশকিছু উৎসব পালিত হয়। যেমন প্রথম দিব্য প্রবচন বা first speech enlightment, নির্বাণ দিবস, নববর্ষ এবং দালাইলামার জন্মদিনের উৎসব পালিত হয়। 
 
টাইগার পয়েন্ট:- ম্যানপাটের সবথেকে আকর্ষনীয় ও জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান হল টাইগার পয়েন্ট। গভীর ঘন জঙ্গলের মধ্যে চারদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা। পর্বতমালার মাঝখান থেকে কল কল করে বয়ে চলেছে উচ্ছল পাহাড়ি ঝরনা যার উচ্চতা প্রায় ৬০ মিটার মতো।এই স্থানটি বাঘের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে । সম্ভবত বাঘেরা হয়তো এখানে জল খেতে আসে। 

মাচালি পয়েন্ট ও ফিশ পয়েন্ট:-এটি হচ্ছে ম্যানপাটের সব থেকে সুন্দর দর্শনীয় স্থান। চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা পর্বতমালার মাঝে সুন্দর স্রোতস্বিনী মাচালি নদী। এই নদীতে অনেক ছোট ছোট মাছ দেখতে পাওয়া যায়। এই প্রবহমান নদী আবার কিছুদূর গিয়ে উচু পাহাড় থেকে কলকল শব্দে ঝর্ণার রূপ ধরে বয়ে চলেছে। চতুর্দিকে পর্বতমালার মাঝে দুটো মুখোমুখি অদ্ভুত সুন্দর জলপ্রপাত আছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকনা উপরে উঠে যখন বাষ্পের আকার নিচ্ছে তখন মনে হচ্ছে যেন চারিদিক ধোঁয়াশা । অদ্ভুত সুন্দর এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যা হয়তো বর্ণনা করে ঠিক বোঝানো যাবে না ওখানে গিয়ে অনুভব করতে হবে। ৮০ মিটার উপর থেকে সাদা জলপ্রপাত যখন নিচে পাথরের উপর পড়ে বয়ে চলেছে তখন মনে হয় যেন পাথরের উপর দিয়ে দুধের ধারা বয়ে চলেছে। 

দলদলি:-ম্যানপাটের পরবর্তী জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান হল দলদলি। দলদলি ছাড়াও একেজলজলি এবং জাম্পিং ল্যান্ড ও বলা হয়এই নির্দিষ্ট স্থানের মাটিতে লাফালে মনে হয় মাটিটা যেন দুলছে। লাফালে ঠিক যেন মনে হয় স্পঞ্জের গদির উপর লাফাচ্ছি। এখানেও জলপ্রপাত আছে কিন্তু সেটা হিডেন বা লুক্কায়িত। ওটা দেখতে যাওয়া বেশ বিপদসংকুল তাই রিক্স না নেওয়াই ভালো। 

মেহতা পয়েন্ট ও পরপাটিয়া সানসেট পয়েন্ট:-মেন পাট থেকে মাত্র ৮কিলোমিটার দূরে মেহতা পয়েন্টে দেখতে পাওয়া যাবে মনমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝখানে সুন্দর ঝরনা বা জলপ্রপাত। সরগুজা ও রায়গড় সীমান্তে এই জলপ্রপাতটি অবস্থিত । এখানে যাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা আছে।পরপাতিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতি মনমুগ্ধকর যা দেখলে আপনার স্মৃতিপটে বহুদিন আঁকা থাকবে। চারিদিকে সবুজের সমারোহ তার মাঝে মাঝে পর্বতমালা। এখানে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান আছে। যেমন বন্দরকোট পাহাড়, রকসামদা গুহা, দুলহা দুলহান পাহাড়, বনরাল বাঁধ, শ্যাম ঘুনঘুটা বাঁধ ও রামগড়ের পাহাড়। পর্যটকরা এখানে প্যারাগ্লাইডিং করতেও আসে। এখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতে পর্যটকদের প্রচুর ভিড় হয়। সূর্যাস্তের সময় দূরের পাহাড় গুলোকে মনে হয় যেন সারি সারি কিউব আকৃতি এক লাইনে দাঁড়িয়ে ঠিক যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবি।দূর আকাশে পাহাড়ের কোলে সূর্যাস্তের লালচে আভায় পাহাড় ও জঙ্গলের যে অনির্বচনীয় রূপ দেখতে পাওয়া যায় তা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। 

 উল্টা পানি বা উল্টো ধারা:-ম্যান পাটের একটি জনপ্রিয় দর্শনীয় জায়গা এটি। এখানে জল উতরাই থেকে চড়াই এর দিকে মানে প্রবাহের উল্টো দিকে বয়ে চলে। ম্যানপাট পৌঁছানোর ৬ কিলোমিটার আগে রয়েছে এই উল্টাপানি। চড়াই-উৎরাই পাহাড়ি পথ বেয়ে এই উল্টাপানি গ্রাম। সরু নালা বেয়ে জলধারা এখানে উপর দিকে প্রবাহিত। এখানে একটা জায়গা আছে যেখান থেকে বন্ধ গাড়ি আশ্চর্যজনকভাবে আপনা আপনি চলতে শুরু করে এবং বেশ স্পিডে চলে।বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে এরকম ম্যাগনেটিক হিল ভারতবর্ষের লে লাদাখ ও গুজরাটের ভুজ এলাকায় ও আছে। 

 বার্ড ওয়াঢ ও জঙ্গল ট্রাকিং:-যদি আপনি জঙ্গল ও অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসেন তাহলে অবশ্যই ট্রাকিং এ যেতে পারেন। ম্যানপাটের বেশ কয়েকটা জঙ্গলে অ্যাডভেঞ্চার করানো হয়। এখানকার জঙ্গলগুলিতে বেশকিছু আয়ুর্বেদিক ওষুধের গাছগাছরা ও পাওয়া যায়। এছাড়া জঙ্গলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে শাল ,মহুয়া, শিমুল পলাশের বন.. সোনাঝুরি গাছ। শিমুল পলাশ সোনাঝুরি গাছ ও লাল মাটির রাস্তা শান্তিনিকেতন ও খোয়াইয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। নানান রকমের বিভিন্ন রং এর সুন্দর সুন্দর ফুল আপনি দেখতে পাবেন জঙ্গলে। যেমন পাইনফুল ,নীলতিসি ফুল ,সজনে ফুল, ঘাসফুল, অগ্নিলতা বা সোনাঝুরি লতা ইত্যাদি।নানান রংয়ের সুন্দর দেখতে প্রচুর প্রজাতির পাখি ও এখানে আছে।বার্ড ওয়াচ করার জন্য একবার এখানে আসতেই পারেন। 

জলপরী পয়েন্ট ওয়াটারফল:-ফিশ পয়েন্ট থেকে জলপরী পয়েন্ট এর দূরত্ব মোটামুটি ১০ কিলোমিটার। দু কিমি ট্রাকিং করে আসতে হবে। এখানেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সুন্দর জলপ্রপাত পর্যটকদের আনন্দ দেয়। 

ঘাঘী জলপ্রপাত:-ম্যান পার্ট থেকে নিচে নেমে 4 কিলোমিটার ভেতরে গেলেই ঘাঘী জলপ্রপাত দেখতে পাওয়া যায়। জঙ্গল পাহাড়ের মাঝখানে এই জলপ্রপাত সুন্দর পিকনিক স্পট।অম্বিকাপুর, রায়গড়, সরগুজা ও আশেপাশে অনেক জায়গা থেকেই মানুষজন এখানে পিকনিক করতে ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন। টিনটিনি পাথর (Thin Thini Phathar ):-এটা একটা অদ্ভুত আশ্চর্য রকমের পাথর। ম্যানপাট থেকে নিচে নেমে এলে এই পাথর দেখতে পাওয়া যায়। একটাই বড় পাথরের চাঁই। আশেপাশের পড়ে থাকা ছোট পাথর দিয়ে যদি এই আশ্চর্যজনক টিনটিনি পাথরের উপর বাজানো হয় তাহলে দশ রকমের বেশি মেটালের বা ধাতুর আওয়াজ পাওয়া যায়। শুনতে দারুন লাগে। দূর দূর থেকে বহু পর্যটক এসে এই পাথর বাজিয়ে ও মেটাল এর আওয়াজ শুনে আনন্দ পান।ম্যানপাটে বেশ কিছু পাহাড়ি ঘাঁটি আছে যেগুলো সবুজের সমারোহতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এছাড়া বেশকিছু মন্দির আছে যেগুলি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু । এগুলি হলবৌদ্ধ মঠ, কলামন্দির, বানজারা মন্দির , জঙ্গলেস্বর মন্দির, শিবালয় মন্দির ইত্যাদি।আপনি যদি প্রকৃতি প্রেমিক হন তাহলে সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে থাকা এই শৈলশহরটিতে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে, পাহাড় জঙ্গল ঝর্ণার সহাবস্থান ও অনন্ত রূপ রাশি দেখতে এবং পৃথিবীতে স্বর্গীয় সৌন্দর্য দেখতে অবশ্যই একবার এখানে এসে ঘুরে যেতে পারেন। 

প্রয়োজনীয় তথ্য:-কোথায় থাকবেন:-ছত্রিশগড় ট্যুরিজমের অধীনে একটা খুব ভালো পর্যটন আবাস আছে ম্যানপাটে, যেখানে থাকা-খাওয়ার সুবন্দোবস্ত আছে। এছাড়া অম্বিকাপুরে অনেক বড় বড় হোটেল ও লজ পাওয়া যায়। 

 কিভাবে যাবেন:-কলকাতা থেকে ট্রেনে রায়গড় আসতে ৯ঘন্টা লাগে। রায়গড় থেকে গাড়িতে ১২০ কিলোমিটার সীতাপুর। সীতাপুর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে ম্যানপাট।এছাড়া অন্যভাবেও আসা যায়। হাওড়া থেকে বিলাসপুর অনেক ট্রেন আছে। বিলাসপুর থেকে অম্বিকাপুরের দূরত্ব ২৪০ কিলোমিটার। আর অম্বিকাপুর থেকে ম্যানপাট ৬০ কিলোমিটারের মতো।