ভ্রমণ পিপাসু মানুষজন এতদিনে দুর্গাপূজো ভ্রমণের রূপরেখা তৈরী করে নিয়েছেন নিশ্চই । কেউ পাহাড়, কেউ জঙ্গল, কেউ সমুদ্র আবার কেউ মরুভূমি চলেছেন । আমিও তেমনি পাহাড়েই চলেছি, তবে আমি যেখানেই যাইনা কেন পূজোর দুটো দিন বোলপুর যাবোই যাবো । আজ এখানে আমার গত বছরের দুগ্গোপূজোয় বোলপুর ভ্রমণ লেখনীর মাধ্যমে সবাই কে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি একবারটির জন্য বোলপুরের দুগ্গোপূজো দেখতে আসুন ।২০২১ এও আমরা ৫ টা পরিবার অষ্টমীতে বোলপুর এসেছিলাম । একমাস আগে ঠিক করে ছিলাম তাই ট্রেন সিট্ সংরক্ষণ ও হোটেল নিয়ে চাপ ছিল না । তবে বড় নামের ও বড় মানের হোটেল গুলো এই সময় ৪ দিনের প্যাকেজ ছাড়া বুকিং নেয় না আর সেটাও খুব ব্যয়সাপেক্ষ ।আমরা শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস চেপে এসেছিলাম এবং উঠে ছিলাম বীরভূম গেস্ট হাউসে । এই সময় দুজনের থাকার ঘর অ্যাটাচ বাথ সহ ৭০০ টাকা পূজো বলে আর মাত্র দুদিন বলে ওরা নিলো ১১০০ টাকা করে । খাবার আলাদা ৪০০ টাকা করে এক একজনের ।এবার আসছি দুর্গাপূজো তে কেন বোলপুর! বোলপুর এমন একটা জায়গা যেখানে জামবনির পূজোয় পাবেন কলকাতার ম্যাডক্স স্কোয়ারের অনুভূতি , কারণ বিরাট মাঠ জুড়ে প্যান্ডেল, তার লাগোয়া গানের মঞ্চ, সারা মাঠে খাবার দাবার ষ্টল , দল বেঁধে নাচ, গান, নাটক এছাড়া কলকাতাকে যেটা টেক্কা দেয় সেটা হলো যাত্রাপালা। ৪ দিনে চারটে যাত্রা দল এখানে তাদের নতুন যাত্রা উপস্থাপন করে ।কলকাতায় গ্রামের পূজোয় থিম বানাতে সুদূর বাঁকুড়া, মেদিনীপুর থেকে শিল্পী ধরে এনে একটা ঝুলন সাজানো হয় আর এটাকেই যদি জীবন্ত দেখতে চান তবে চলে আসুন হীরালিনী মায়ের পূজোয় । এটা সোনা ঝুড়ি জঙ্গলে আদিবাসী মানুষজনের পূজো। মা দুর্গার এখানে অন্য রূপ, লোহা দিয়ে তৈরী এই দূর্গা মা, এক শিল্পের উপস্থিতি । ঘটে মায়ের পূজো হয়, সারা রাত ধরে চলে বাউল গান, সাঁওতালি নাচ গান, বিভিন্ন দলে দলে আখড়া আরকি । তিনদিনই মায়ের ভোগ প্রসাদ হয় । আমি যতদূর জানি এই পূজো বাঁধন দাস শুরু করেছিলেন । আমি ওনার আমল থেকে এই পূজো দেখে আসছি, খুব কাছ থেকে, আর এখন উনি নেই তাই আমি আজও এই দুগ্গোপূজো দেখতে প্রতি বছর যাই, তবে এখন দূর থেকেই দেখি । কলকাতা থেকে অনেক বিশিষ্ট মানুষজন ও অনেক তারা নক্ষত্র এই পূজোয় উপস্থিত থাকেন । জীবন্ত থিম দেখতে আসুন শ্রীনিকেতন এর সুরুল এর ছোট বাড়ি বড় বাড়ির দুগ্গো পূজো , বড় বাড়ির পূজো ছোট বাড়ির থেকে অনেক বেশি জাঁকজমক পূর্ণ , তবে দু বাড়ির দুগ্গোপূজোতে একটা প্রাণ আছে । এখানে পূজোর দিনগুলো সন্ধ্যায় দারুন এক অনুভূতি পাওয়া যায় l জমিদার বাড়ির বাইরে বেশ বড়সড় গ্রাম্য মেলা বসে । ধুনোর গন্ধ,ঢাকের আওয়াজ ফুচকা, আলু কাবলি, চিনে বাদাম ভাজা, জিলিপি ভাজার গন্ধে বয়সটা ১৫ বছরে নেমে আসে । এই পূজো ৩০০ বছরের পুরোন পূজো,বর্ধমানের ঘোষ পরিবার এই সুরুল গ্রামে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করেন ও ব্রিটিশ সরকার এনাদের তখনকার দিনের সন্মানিক উপাধি " সরকার " উপাধিতে ভূষিত করেন । ১৫০ বছর হলো এই পূজো ছোট বাড়ি, বড় বাড়িতে বিভক্ত হয়েগেছে । রায়পুর জমিদার বাড়ির পূজোটাও খুব প্রাণবন্ত । এছাড়া বোলপুরে আরও শ খানেক পূজো হয় । শ্যামবাটী ঠাকুর বাড়ির পূজোটাও খুব নিষ্ঠা সহকারে হয় । রতন পল্লির পূজো এখন অনেক জাকজমক পূর্ণ রূপ নিয়েছে । আমি বছর ১৫ আগেও দেখেছি পাড়ার দাদু দিদা, কাকা কাকি, দাদা বৌদিদের, ধুতি শাড়ি দিয়ে নিজেরাই প্যান্ডেল করতো । এখানে এখনো সারারাত বাউল গানের আসর বসে, এছাড়া মুরগির লড়াই, হাঁড়ি ভাঙা , দড়ি টানা টানি আরও কত প্রতিযোগিতা মূলক খেলা হয় । শ্যামবাটীর খালের ওপারে আদিবাসী গ্রামের পূজো যার বিসর্জনের শোভাযাত্রা আজও ভুলতে পারিনা ।এখনো এই ঐতিহ্য এরা টিকিয়ে রেখেছে । কালো রূপের আদিবাসী মেয়ে বৌ দের সিঁদুর খেলার যে রূপ, তা চোখ ফেরানো যায় না , খুঁজে নিতে হবে যে লাল রং কালোতে বেশি সুন্দর না কালো রংটা লালে বেশি সুন্দর । সুরশ্রী পল্লী মিশন কম্পাউন্ড এর পূজো কলকাতার থেকে কোনো অংশে কম নয় বরং বেশিই । এটা থিম পূজো হলেও একটা সাবেকি ভাব আছে ।এছাড়া বোলপুরে কয়েকটা বেশ বড় সাবেকি পূজো হয়, যেমন - নতুন পুকুর দুগ্গোৎসব , বলাকা সংঘ , দালালপাড়া, রেল ময়দান এবং কলেজ পাড়ার দূর্গা পূজো বেশ মন কারে।একটা সময় বোলপুর বলতে আমরা বুজতাম লালমাটির পথ, গ্রামের মাটির দেওয়াল খড়ের ছাউনি। গরুর গাড়ি, সরু পিচ রাস্তার দুধারে সবুজ ধানক্ষেত, রাস্তায় শুধু সাইকেল, রিক্সা, মাঝে মাঝে দুএকটা যন্ত্র চালিত পরিবহন।সন্ধ্যে হলেই বোলপুর যেন এক ঘন অন্ধকারে ডুবে যেত। আর আজ সেই বোলপুর রাস্তাঘাট আলো ঝলমলে, রাস্তায় গাড়ি, মোটরসাইকেল ছোটাছুটি করছে। বড়ো বড়ো ব্র্যান্ডেড দোকান, বিলাসবহুল হোটেল, রিসর্ট।বোলপুরের এই উন্নয়নের পেছনে আছে এখানকার কিছু সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ প্রতিষ্টিত মানুষের অবদান।আমি প্রথমেই বলবো রাধেশ্যাম আগারওয়ালের কথা, যিনি একজন ভিন দেশের মানুষ হয়ে এই প্রত্যন্ত গ্রামে দিনের পর দিন পরে থেকেবহু লড়াই করে আজ একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। এক সময় খুবই ছোট একটা ব্যবসা দিয়ে শুরু করে আজ তিনি এক সাম্রাজ্যের মালিক। তার কর্মস্থলে আজ প্রচুর মানুষ কাজ করবার সুযোগ পেয়েছে। উনি কিন্তু মনের দিক থেকে একই আছেন, কোনো পরিবর্ত্তন হয়নি। ওনার কাপড়ের দোকানের নাম বোলপুর ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর দূরান্তে পৌঁছে গেছে শুধু ওনার ভালো ব্যবহার ও জিনিসের মানের গুনে। এ ছাড়াও ওনার অজস্র ব্যবসা। ওনার দেন ধ্যানের হাত প্রচুর। ওনার সমাজ সেবার কাজ অনেকেই জানেনা। উনি প্রচার করে কোনো সমাজসেবা করেন না। এই ভদ্রলোক বোলপুরকে দিয়েছে অনেক উন্নয়ন। আর আছে ঝিনুক কন্সট্রাকশনের কর্ণধার বুড়ো ঘোষ, ওনার ভালোনাম চাপা পরে গেছে সকলের প্রিয় বুড়োদা নামের কাছে। উনি বোলপুরকে দিয়েছেন এক আধুনিক ঠিকানা অথচ বোলপুরের সংস্কৃতি ও রূপকে বিকৃত না করে। উনি দিয়েছেন বোলপুরকে কর্মসংস্থানের ঠিকানা,ওনার আবাসন শিল্পের থেকে বোলপুরের অনেক পরিবার পেয়েছে জীবনের বেঁচে থাকার রসদ। প্রচুর কর্মসংস্থান দিয়েছেন। বিশ্বভারতী ছাড়া, বোলপুরের অর্থনীতিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে দিয়েছে ও দিচ্ছে পর্যটকরাও। পর্যটনকে ঘিরে এখানকার হোটেল, রেস্টুরেন্ট,পরিবহন, হস্তশিল্প ব্যবসার প্রসার ঘটছে। অজস্র হোটেল হয়েছে এবং সেখানেও প্রচুর কর্মসংস্থান হয়েছে। তাই লপুরের উন্নয়নের পেছনে হোটেল মালিকদের অবদান প্রচুর। শিশির ভেজা শরৎকাল অনেক দেখেছেন কিন্তু বোলপুরের শারদীয় শরৎ কে একবার ছুঁয়ে যান না গো। কাশফুলের হাওয়ায় শিউলির গন্ধে মন প্রাণ জুড়িয়ে দেয়, লালমাটির পথ, সবুজ বনানী, কোপাইয়ের টলটলে জলে নীল আকাশের প্রতিবিম্ব, নদীর দু পারে সাদা কাশফুলের দাপাদাপি, এ এক অন্য অনুভূতি, যেখানে পাহাড়ের শীতলতা পাবেন না , সমুদ্রের উচ্ছলতা পাবেন না, মরুভূমির নিস্তব্ধতা পাবেন না, কিন্তু পাবেন সবুজ সজীবতা, শিউলির শীতলতা , কাশফুলের প্রফুল্লতা । তাইতো আমার শহরের দুর্গা মা কে এখানে দুগ্গা রূপে পাই , আমার দুগ্গা এক সাঁতারে এনে দেবে এক মুঠো পদ্ম ফুল অথবা নীল শালুক ফুল বিনিময় যা দেবেন হাসি মুখে নিয়ে আবার ঝাঁপাবে জলে আরও কিছু পয়সার সন্ধানে । পূজোতে তাই দুটো দিন আসি, এই সরল মনের মানুষ গুলোকে পাই, শুধু দুর্গা মা কে নিয়ে নয় আমার দুগ্গাদের নিয়েও দুটো দিন ভালোই লাগে , যাবার আগে আমার দুগ্গার কথা একটু বলি! "আমার দুগ্গা নেইতো তার ত্রিনয়নী সেই মুখ ।আমার দুগ্গা পায়নি কোনোদিন খাওয়াপড়ার সুখ ।আমার দুগ্গা নেয় না কখনো খাওয়া পরার চাঁদা, আমার দুগ্গা রোজগার করে পায়ে মেখে কাদা।আমার দুগ্গা পায়না কখনো,ওঁ জয়ন্তি,মঙ্গলা,কালি,ভদ্রকালি,কপালিনি মন্ত্র।আমার দুগ্গা লড়াইকরে,পাওয়ার তরে ,দুবেলা দুমুঠো অন্ন .এটাই তার স্বতন্ত্র "।