সুব্রত সরকার
" কাঞ্চনকন্যা রাজাভাতখাওয়া স্টেশনে থামে না। সোজা চলে যায় আলিপুরদুয়ার জংশন। কিন্তু কখনো কখনো আবার সিগনাল না পেয়ে দাঁড়িয়ে যায় রাজাভাতখাওয়ায়। আপনার সে গুড লাক হলে আরামসে নেমে পড়বেন। তাহলে গারো বস্তি চটজলদি চলে আসতে পারবেন।" আসার আগে ফোনে লাল দার সাথে এমন কথাই হয়েছিল। লাল দা মানে লাল সিং ভুজেল।
আমিও তক্কে তক্কে ছিলাম। ট্রেন হ্যামিলটনগন্জ স্টেশন ছেড়ে এগোতেই আমার ন্যাপস্যাকটা পিঠে ঝুলিয়ে কাঞ্চনকন্যার গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে চা বাগান দেখতে দেখতে চললাম। এবং কি আশ্চর্য আটিয়াবাড়ি চা বাগান পেরতে না পেরতেই ট্রেনের গতি মন্থর হতে শুরু করল। ডিমা নদীর ব্রিজ, চৈতন্যঝোরার লেভেল ক্রশিং এর কাছে এসে ট্রেনের গতি আরও কমে গেল। আমি বুঝে গেলাম, ট্রেন থামছেই রাজাভাতখাওয়ায়। আমার গুড লাক আজ! সত্যি সত্যি সিগনাল লাল দেখে কাঞ্চনকন্যা থমকেই গেল। লাল দার কথা একদম মিলে গেছে।
রাজাভাতখাওয়ার প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে আমার বগিটা একটু এগিয়ে গিয়েছিল। কোই বাত নেহি- দিলাম লাফ! গড়িয়ে পড়লাম রাজাভাতখাওয়ার মাটিতে। আহ্ কি আনন্দ! আমার ছোট্ট ছুটির একলা ভ্রমণের সেরা ঠিকানা পুব ডুয়ার্সের এই রাজাভাতখাওয়ার বন- জঙ্গল, পাহাড়- নদী আর আশপাশের ছোট ছোট বিখ্যাত সব জনপদ। তাই সুযোগ পেলেই পালিয়ে আসা।
এবারও এলাম। নির্জনতার কাছে নতজানু হতে গারো বস্তির গভীর সবুজ অন্ধকারে চলে আসা। এবার শুধুই গারো বস্তি ও আটিয়াবাড়ি চা বাগান। রাজাভাতখাওয়ার ওপারে যাব না। জয়ন্তী, বক্সা পাহাড়, সান্তালাবাড়ি,২৯ বস্তি দেখা হবে না।
হামরো হোম এর কাঠ বাংলোর দোতলার বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে দূরের সিনচুলা রেঞ্জ, ভুটান পাহাড়ের আবছা ঢেউ আর বক্সা পাহাড়ের দিকে চোখ রেখে উদাস হয়ে গেলাম। কি অপরুপ এক নির্জনতা গারো বস্তিকে শান্ত করে রেখেছে। কত গাছ হামরো হোম এর চারপাশে। গামার,জারুল, চাপ, রুদ্রাক্ষ, চিকরাশি, লাটোর। আর বাগানে প্রতিদিনই পাখিদের জলসা হয়। সেখানে গাইতে আসে পাহাড়ি ময়না, বনটিয়া, ধনেশ পাখিরা।
দুপুরে খাওয়ার পর বারান্দায় বসে একান্তে রবিঠাকুর শোনা হল,"মধ্যদিনের বিজন বাতায়নে/ ক্লান্তি- ভরা কোন্ বেদনার মায়া/ স্বপ্নাভাসে ভাসে মনে- মনে.." বিকালের শুরুতেই পায়ে পায়ে এগিয়ে চললাম রাভা পাড়ার দিকে। সঙ্গী লাল দা। টিনের ছোট ছোট বাড়ি, সুপুরি গাছের সারি দিয়ে ঘেরা রাভাদের ঘর উঠোনগুলো। আলাপ পরিচয় করে একটু গল্প হল দুই রাভা কন্যার সাথে। ওরা তখন চার্চে যাচ্ছিল, হাতে বাইবেল। বেশ স্বপ্রতিভ দুই রাভাকন্যাকে দেখে ভালো লাগল।
সন্ধ্যা হবে হবে, সূর্য ডুবু ডুবু আলোয় হাতির ভয়ে পা চালিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। লালদার সাথে দিব্যি গল্প করতে করতে চলে এলাম। কাল সকালের ভ্রমণ আটিয়াবাড়ি চা বাগান আর ডিমা নদীর চর।
গারো বস্তির চারপাশে এখন অন্ধকার নেমে এসেছে। দূরের পাহাড়গুলোতে কারা যেন সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বেলে দিয়েছে। কি সুন্দর আলোর ঝিকিমিকিতে একটা মায়বী মন কেমনের আনন্দ হচ্ছে মনে। আমি এই নির্জনতায় বসে আমার একলা ভ্রমণের আনন্দ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছি।
হঠাৎ এই নির্জনতাকে ভেঙে দিয়ে দূর থেকে ভেসে এল এক প্রবল হৈচৈ আর হল্লা- চিল্লা। পটকা ফাটতে শুরু করেছে। টিন পেটানোর তীব্র আওয়াজ ভেসে আসছে। লালদা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল," রাভা পাড়ায় আজ আবার হাতির পাল এসেছে। ওদের ক্ষেতি জমিতে এখন পাকা ভুট্টা। হাতিরা সব সাবাড় করে দিয়ে যাবে।"
আমি খুব চঞ্চল হয়ে পড়লাম। অন্ধকারে এমন পটকা ফাটা ও মানুষজনদের দৌড়াদৌড়ি দেখে। হাতির দলটা বেশ বড় মনে হল। এমন সময় আবার বিপদ ঘন্টা বাজিয়ে দু' দুটো কালো জিপ তীব্র হেড লাইট জ্বালিয়ে ছুটে আসছে দেখলাম। লাল দা বলল,"BTR এর গাড়ি। বক্সা টাইগার রিজার্ভে ঠিক খবর পৌঁছে গেছে।"
হাতির পাল মনের আনন্দে পাকা ভুট্টা খাচ্ছে। গ্রামের মানুষ জন পটকা ফাটিয়ে, টিন পিটিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে হাতি খেদাতে। BTR এর গাড়ি থেকে ফরেস্ট গার্ডরা নেমে পড়েছে। এবার কি হয় তা দেখার জন্য আমি অধীর হয়ে বারান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইলাম। অনেক রাতে শান্ত হল গারো পাড়া। হাতির পালকে খেদিয়ে জঙ্গলে ফেরত পাঠানো গেছে। ডিনার টেবিলে খেতে খেতে অনেক গল্প হল লালদার সাথে। হাতির গল্প যেন আর শেষ হয় না।
জঙ্গলের জংলী হাতি পেটের জ্বালায় লোকালয়ে- জনপদে, বন বস্তিতে বারবার চলে এসে মানুষের অনেক কষ্টে করা ক্ষেতি- জমির শস্য-ফসল নিমেষে সাবাড় করে দিয়ে চলে যায়। এ করুণ বাস্তবতার গল্প শুনতে শুনতে গারো বস্তির রাত গাঢ় হয়।
ভ্রমণে এসে শুধুই যে বেড়ানো হয় তা নয়, জানা বোঝাও হয় অনেকটা। তাই সব ভ্রমণই একই সঙ্গে যেন দেখা ও শেখা-- তা আরও একবার উপলব্ধি করতে পারলাম গারো বস্তির নির্জনতায় এসে!...