The zamindari of the three parganas of the Tagore family came to look after it. Zamindar Rabindranath was staying at Shilaidaha Kuthi Bari, Shahjadpur Kachari Bari and Patisar Kuthi Bari at this time.
ঠাকুর পরিবারের তিনটি পরগণার জমিদারি দেখাশােনার কাজে এসে পূর্ববঙ্গের নদীমাতৃক শ্যামলী প্রকৃতির মাঝে রবীন্দ্র প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ও তার কিরণ ছড়িয়ে পড়ে বাংলার সাহিত্যাকাশে। জমিদার রবীন্দ্রনাথ এই সময়ে শিলাইদহ কুঠি বাড়ি, শাহাজাদপুর কাছারি বাড়ি ও পতিসর কুঠি বাড়িতে অবস্থান করতেন। তকালীন পূর্ববঙ্গের এই কুঠি ও কাছারি বাড়ি বর্তমান বাংলাদেশের পৃথক পৃথক জেলায় যেমন শিলাইদহ কুঠি বাড়ি কুষ্টিয়া জেলায়, শাহজাদপুর কাছারি বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলায় এবং পতিসর কুঠি পাড়ি নওগাঁ জেলায় অবস্থিত। এছাড়া রবিঠাকুর বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন এই বাংলাদেশেরই খুলনা জেলার দক্ষিণডিহি পল্লির মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে। জমিদারি পরিচালনার কাজে তিন পরগণার কুঠি ও কাছারি বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ নদীপথে যাতায়াত পছন্দ করতেন। পদ্মা-গড়াই-ইছামতী-নাগর নদীতে তাঁর প্রিয় পদ্মা বােট ছাড়াও চিত্রা, চপলা ও চঞ্চলা নামের নৌকাগুলিতে ইচ্ছেমতােই সওয়ারি হতেন। রবিঠাকুরের প্রতিভা স্পর্শে এইসব নদী নৌকা পল্লি আজ আর কারও অচেনা নয়। বাংলাদেশের রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য শিলাইদহ, পতিসর, শাহাজাদপুর ও দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র অনুরাগী সহ আপামর বাঙালী ও ভ্রমণার্থীর কাছে চিরন্তন রবীন্দ্র-তীর্থ।
শিলাইদহ কুঠিবাড়ি
চৈত্র মাসের রাত। তারায় ভরা আকাশ। মায়াবী জ্যোৎস্নায় রূপােলী আভা এসে থমকেছে মখমল কোমল ঘাসে। শিলাইদহে। ১৯১২ সালে পায়চারি করছিলেন রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ কুঠি বাড়ির দোতলায়। কথা ছিল বিলেত যাওয়ার। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সিঁড়িতে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার পর ডাক্তারের পরামর্শে বিশ্রামের জন্য কলকাতা থেকে তাই সােজা শিলাইদহে। ‘কোন চৈত্রমাসে বকুল ঢাকা বনের ঘাসে..’ আপতিত চন্দ্রালােকিত আলাে-আঁধারি খেলায় উদাসীন রবীন্দ্রনাথ আপন খেয়ালে শিলাইদহ কুঠি বাড়ির দোতলায় শুরু করলেন গীতাঞ্জলির ইংরাজী অনুবাদ। তারপর বাকিটা তাে ইতিহাস। পদ্মা পারের শিলাইদহ কুঠি বাড়িতে কবির প্রায় দশ বছরের বাস (১৮৯১-১৯০১) আর অসামান্য সব সৃষ্টি এখানেই। তার প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশের বয়সকাল ত্রিশ থেকে চল্লিশ, শিলাইদহে অতিবাহিত। সােনার তরী, চিত্রা, চৈতালী, কণিকা, ক্ষণিকা, কল্পনা, কথা, নৈবেদ্য, চিত্রাঙ্গদা, মালিনী, গান্ধারীর আবেদন, বিদায় অভিশাপ, কর্ণ কুন্তী সংবাদ, নরকবাস, সতী, লক্ষ্মীর পরীক্ষা, গল্প গুচ্ছের অনেক ছােট গল্প, ইন্দিরাদেবীকে লেখা ছিন্নপত্রাবলীর অধিকাংশ চিঠি এ সমস্তই তার এই সময়কালের সৃষ্টি এবং তা একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালী কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠার পক্ষে যথেষ্ট।
পদ্মা পারে অখ্যাত পল্লী, ব্যস্ত জনপদ আর গ্রাম বাংলার সবুজের পসরা সাজানাে শিলাইদহে স্বর্গ যেন নেমে এসেছে মাটির পৃথিবী পানে। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা গ্রাম বাংলার রূপটি এখানে বেশ ধরা পড়ে। আর রবি ঠাকুরের ছবি ও তার আঁকা ছবি নিয়ে এখনও যেন এক গাথা-সুদৃশ্য শিলাইদহের কুঠিবাড়ি।
বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার পদ্মা-গড়াই-এর মােহনায় অবস্থিত শিলাইদহ। শিলাইদহের ঠিক উল্টোদিকে পদ্মার ওপারে পাবনা শহর। শিলাইদহ নামে নবীন। পূর্ব নাম খােরশেদপুর। শােনা যায় শেলী নামে এক নীলকর সাহেবের বাস ছিল পদ্মা-গড়াই-এর মােহনায় গড়ে ওঠা দহের কোল ঘেঁষে। পল্লীর লােকেরা বলত শেরীর দহ। যা পরে হয়ে দাঁড়ায় শিলাইদহ। বর্তমানে বাংলাদেশের জেলা সদর কুষ্টিয়া থেকে দূরত্ব দশবারাে কিলােমিটার। কুষ্টিয়ার ঘােড়ার ঘাটে এক টাকা দিয়ে এক মিনিটে ফেরী পার হয়ে অটো রিক্সা বা ভ্যান রিক্সা করে এখানে চলে আসা যায়। গাড়ি নিয়েও একটু ঘােরা পথে সেতু পেরিয়ে আসা যায়। রাস্তার দু'পাশ গাছ-গাছালিতে শ্যামলে শ্যামল। থাকার জন্য রয়েছে কুঠি বাড়ি সংলগ্ন জেলা পরিষদের ডাকবাংলাে ‘সােনার তরী'। অদূরে পদ্মা। চিকচিক করে ওঠে বালি। দূরে পদ্মা চর। কুঠি বাড়ির পাশেই পদ্মার ঘাট। এই ঘাটে বাঁধা থাকতাে রবি ঠাকুরের বড় আদরের ‘পদ্মা বােট’ কখনও বট গাছে, কখনও বা বেল গাছে। অনাদরে, অব্যবহারে পদ্মা বােট ধ্বংস হয়ে গেছে পদ্মার বুকেই। বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিক ইচ্ছেয় পদ্মা বােটের একটি রেপ্লিকা তৈরির কাজ চলছে কুঠি বাড়ির সংলগ্ন এলাকায়। শিলাইদহের জমিদারি হাতছাড়া হওয়ার পর অব্যবহৃত পদ্মা বােট জীর্ণ হতে হতে পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। তবে লােহার তৈরি কবির স্পীড বােটটি রূপােলী রঙ করে কুঠি বাড়ির দোতলায় সযত্নে এখনও রাখা। স্পীড বােটটির নাম কবি রেখেছিলেন চপলা।।
কুঠিবাড়ির পাশেই বেশ বড়সড় একটা পুকুর। পুকুর পাড়ে বয়স্ক একটা বকুল গাছে লেখা আছে ‘স্মৃতি বিজড়িত বকুল গাছ। পুকুরের চারপাশে নারকেল, কাঠাল, কাঠ বাদাম, কদম, ছাতিম, সুপারি সহ আরও কত কি সব গাছ। গাছে শিস দিয়ে চলে দোয়েল। একজোড়া বেনেবৌ থেকে থেকে উড়ে বেড়ায় সােনাঝুড়ি গাছের শাখা-প্রশাখায়।
পদ্মা বক্ষে বরফি আকৃতির সুবিশাল চর। শােনা যায় শীতে পদ্মার চরে কবির অস্থায়ী তাবু পড়তাে। আচার্য জগদীশচন্দ্রের অনুরােধে কবিকে সপ্তাহে অন্তত একটা গল্প লিখতেই হতাে আর তা পড়ে শােনাতে হত জগদীশচন্দ্রকে। সকাল হতে না হতেই কবি-পুত্র রথীকে নিয়ে জগদীশচন্দ্র বেড়িয়ে পড়তেন পদ্মা চরে কচ্ছপের ডিমের খোঁজে। রাতে পদ্মা বােটে সবাই উঠলে বাঁধন খুলে দেওয়া হত। শুরু হত কবির দরাজ কণ্ঠে গান। কখনও বা কবির লেখা ও সুরে গান গেয়ে উঠতেন অমলা— ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা... আপন মনের মাধুরী মিশায়ে...। অমলা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের বােন। কখনও নৌকা বিহারে সাথী হতেন কলকাতা থেকে আসা ভগিনী নিবেদিতা। সেই পদ্মা চর আরও বড় হয়েছে এখন কিন্তু শীতে এখন আর কেউ তাঁবু ফেলে না। | পদ্মা পাড় থেকে শিলাইদহে কবির ‘এ পথে যে গেছি বার বার। মনে করে ফেরার পথে রােমাঞ্চিত হয়ে ওঠে তনুমন। ঢুকে পড়ি শিলাইদহ কুঠি বাড়ির বাগিচায়। সেখানে আমাদের পল্লব ঝরা বাতাসে রবি ঠাকুরের আশিস যেন মাথা ছুঁয়ে যায়। মনে হয় শিলাইদহের গােলাপ বাগিচায় রবিঠাকুর যেন গাইছেন, “আমি রব, উদাস হব ওগাে উদাসী...।
শাহাজাদপুরের কাছারি বাড়ি
ছুটির ফটিক’, সমাপ্তির মৃন্ময়ী’ আর পোেস্ট মাস্টারের রতন’ রবির কলমে জন্ম নিয়েছিল এই শাহাজাদপুরের কাছারি বাড়ির দোতলায় দক্ষিণ খােলা ঘরের রবি ঠাকুরের পড়ার টেবিলে। রবির নিজের কথায় ফটিক মৃন্ময়ীরা শাহাজাদপুর কাছারি বাড়ির আশেপাশের ঘুরে বেড়ানাে জীবন্ত চরিত্র সব। জনশ্রুত ফটিক কাছারি বাড়ির বাগানে রবীন্দ্রনাথের নিজ হাতে লাগানাে গােলাপ ও পদ্মফুল চুরি করতে আসা হরান চক্রবর্তী আর মৃন্ময়ী চরিত্রটি গােপাল সাহার দশ বারাে বছরের বাড় বাড়ন্ত চৌদ্দ পনেরাের মতাে দেখতে কালাে অথচ সুমুখশ্রীর একমাত্র মেয়েটি। আর কলকাতার ছেলে পােস্ট মাস্টার স্বয়ং সন্ধের সময় যুবা জমিদার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নিয়মিত গল্পে আসর মাত করতেন। বর্ষণ মুখর সন্ধ্যায় ঝি ঝি পােকার ডাকে দোতলায় চার চারটি প্রকাণ্ড ঘরে একাকী রবীন্দ্রনাথের লেখনীতে যে আষাঢ়ে গল্পটির সৃষ্টি হয়েছিল তার নাম ক্ষুধিত পাষান। | শাহাজাদপুর কাছারি বাড়ি ঠাকুর বংশের জমিদারদের হাতে আসার পূর্বে আদতে ছিল নীলকুঠি। ইন্দো-ইউরােপিয়ান স্থাপত্যের মিশ্রণে কাছারি বাড়িটি দোতলা। ওপর নীচে চারটি করে মােট আট কক্ষের বাড়ি। পাশেই টালির ঘরে কলিমুদ্দিন আর এনায়েত আলি রবির খাবারের বন্দোবস্ত করত। বাংলাদেশের পাবনা জেলায় সিরাজগঞ্জ মহকুমায় দোতলা হলদে রঙের বিরাট অট্টালিকা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের হস্তগত হওয়ার পর এই বাড়িটিই হয়ে ওঠে শাহাজাদপুরের কাছারি বাড়ি। বর্তমানে বাং লাদেশে তৎকালীন সিরাজগঞ্জ সহ প্রায় সব কটি মহকুমা জেলায় পরিবর্তিত হয়ে ৬৪টি জেলা জন্ম নেওয়ার পর শাহাজাদপুর এখন সিরাজগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত। পাবনা-সিরাজগঞ্জ জাতীয় সড়কের গা ঘেঁষে শাহাজাদপুর বাজার ছাড়ালেই রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য এই শাহাজাদপুর কাছারি বাড়ি। প্রায় দশ বিঘা জমির ওপরে মরসুমী ফুলের সম্ভারে প্রশস্ত সবুজ ঘাসের লনে সুদৃশ্য কাছারি বাড়িটি বাংলাদেশে সরকারের তত্ত্বব্যধানে বর্তমানে সংরক্ষিত। রবির আবাসস্থলের পাশেই কাছারি বাড়ি, মালখানা ও কাছারির আমলা কর্মচারি ও পরিচারকদের আবাসস্থল। কাছারি বাড়ি সংলগ্ন বিশাল মাঠে প্রতি সােম ও বৃহস্পতিবারে এখনও নিয়মিত হাট বসে। সপ্তাহের অন্য দিনগুলিতে এই মাঠে স্থানীয় ছেলেরা ফুটবল খেলে। এই মাঠের উত্তরপূর্ব কোনে বিশাল বপু নিয়ে এখনও দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত অশ্বত্থ গাছ। সময় এখানে থমকে আছে মহামানব রবির স্মৃতি হয়ে। লিচু গাছগুলাের গুঁড়ি দেখে মনে হয় তারাও যেন বাংলা ভাষার বিশ্বে পরিচয়কারি রবিঠাকুরকে চিনত। | পাবনা থেকে সিরাজগঞ্জ আসার পথে করতােয়া নদী পড়ে। করতােয়া নদীর পাড়ের এই অঞ্চলটি বাংলাদেশের ‘দুধের ভান্ডার’ নামে পরিচিত। নদীর বুকে অসংখ্য নৌকো ভর্তি দুধের ক্যান বছরভর দেখা যায়। করতােয়া থেকে এক ক্ষীণকায়া শাখা রবীন্দ্রনাথের জমিদারির সময়কালে শাহাজাদপুর কাছারি বাড়ির পাশ ঘেঁষে বইত। নাম তার খােনকার জোলা। এখন এই জোলা সম্পূর্ণ মজে গেছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ একটি সাইনবাের্ড দিয়ে কাছারি বাড়ির প্রবেশ দ্বারে লিখে রেখেছে ‘খখানকার জোলা’। সামান্য নীচু একটা অংশমাত্র ওই জেলার একদা উপস্থিতির পুরনাে সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। জেলার সাইন। বাের্ডের পাশেই রবীন্দ্রসময়ের এক বুড়াে জামরুল গাছ এখনও বেঁচে। কাছারি বাড়ির অদূরে বাম দিকে প্রায় ধ্বংস হতে বসা ছােট ছােট ঘরগুলির পাশে সাইনবাের্ডে লেখা নীলকুঠি। ভগ্ন নীল কুঠির দাঁত বের করে থাকা হঁটের ওপরে বসে দোয়েল শিস দিয়ে চলে। | শাহাজাদপুর কাছারি বাড়িটি এখন রবীন্দ্রনাথের নামে উৎসর্গীকৃত একটি মিউজিয়াম। কাঠের বড় বাক্স, কাচ ও চিনেমাটির বাসনে ভর্তি আলমারি, বড় বড় কাঠের টেবিল সহ রবীন্দ্রনাথের অতি প্রিয় স্নানের ঘরটি এখনও আছে। এই স্নানঘরে রবি কত গানের যে সুর সৃষ্টি করেছিলেন তা যেন অন্তহীন। আর আছে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত টেবিল হারমােনিয়ামটি যার পর্দায় পর্দায় ‘চিরকুমার সভা'র সুর যেন এখনও অনুরণিত হয়ে চলে।
পতিসর কুঠি বাড়ি
‘দুই বিঘা জমি’র উপেন চরিত্রের সৃষ্টি এখানেই—এই পতিসর কুঠি বাড়ির অন্দরমহলে। পল্লির নাম পতি-সর, আর পাশেই ছােট নদী নাম নাগর। শীর্ণকায়া নাগর নদীকে নিয়ে আমাদের ছােট নদী চলে আঁকে বাঁকে...' এই পতিসরে বসে শিশুদের জন্য লিখে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য এই পতিসর কুঠি বাড়ি বাংলাদেশের নবীন জেলা নওগাঁর অন্তর্ভুক্ত। বগুড়া জেলার সীমানা পেরােতেই এক প্রস্তর ফলক জানান দেয় নওগাঁ জেলায় স্বাগত। গন্তব্য আত্রাই উপজেলার পতিসর। যেখানে রয়েছে ঠাকুরবাড়ির কুঠিবাড়ি। বগুড়া-নওগাঁ জাতীয় সড়ক থেকে বাম দিকে বাঁক নিতে হয় আত্রাই যেতে হলে। বেশ কিছুটা আসার পর এঁকে বেঁকে চলা এক অলস নদীর দেখা মেলে। ছােটরা কোমর জলে নদীজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে স্রোতহীন শীর্ণকায়া নদীর বুকে কোথাও ছােট ছােট চর। রােদুর পড়ে বালুকণা চিকচিক করে ওঠে ওই চরে। এ নদীরই নাম নাগর। আমাদের ছােট নদী’ নাগরকে সঙ্গী করে পাড় ঘেঁষা কংক্রীটের রাস্তায় আধ ঘণ্টা গাড়ি চালনার পর হলদে রঙা সিংহ ফটকের সামনে নেমে পড়তে একটা দৃশ্য দেখে মনটা অপার আনন্দে ভরে যায়। কুঠি বাড়ির বাইরে প্রস্তরে মূর্ত পূর্ণ রবীন্দ্রনাথ চেয়ারে বসে বসে বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছেন। নওগাঁ জেলার আত্রাই অথবা নাটোর জেলার সিংড়া হয়ে আসতে হয় রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত এই পতিসর কুঠি বাড়ি। | শাহাজাদপুর কাছারি বাড়ি হলেও পতিসর কুঠি বাড়ি নামে পরিচিত। এই কুঠি বাড়ির প্রতিটি কক্ষে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত খাট, টেবিল চেয়ার সিন্দুক থরে থরে সাজানাে। দেওয়াল জুড়ে রবির নিজের ও স্ত্রী পুত্র পরিবারের ছবি ল্যামিনেটড করে সুদৃশ্য ফ্রেমে রাখা আছে। একটা ঘরের ভেতর রাখা রবি ঠাকুরের অতি প্রিয় পদ্মা বােটের নােঙর। তবে ওই ঘরে রাখা বিশাল আকারের বাথ টাব বিস্ময় জোগায়। সাদা পাের্সেলিনের টাইলস্ বসানাে সুবিশাল বাথ টাবের শীতল জলে রবীন্দ্রনাথ তারই লেখা গানের সুর সৃষ্টিতে মগ্ন থাকতেন। | পতিসর কুঠি বাড়ি সংলগ্ন শান বাঁধানাে একটা পুকুরের পাশে মার্বেল পাথরে লেখা রয়েছে রবি সরােবর। পুকুরের চারদিকে তেঁতুল আমড়া, খেজুরের উপস্থিতি এক মনােরম পরিবেশের সূচনা করেছে। কুঠি বাড়ির সামনে বেশ কয়েকটি অমলতাস গাছের শাখা প্রশাখা থেকে আঙুরের থােকার মতাে ফুটে থাকা হলদে ফুল কুঠি বাড়ির শােভা বর্ধন করে চলেছে। সামনে খেলার মাঠ। আর খেলার মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়ালেই জলের কলতানে জানান দেয় সে ‘নাগর’—রবির অতি প্রিয় নিতান্তই গ্রাম্য ছােট এক নদী।
রবি ঠাকুরের শ্বশুরালয় দক্ষিণডিহি
কবির মাত্র ১৮ বছরের সংক্ষিপ্ত দাম্পত্য জীবনের সঙ্গীমৃণালিনীর পিত্রালয়ের পল্লির নাম দক্ষিণডিহি। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির সেরেস্তার কর্মচারি বেণীমাধব রায় চৌধুরীর প্রথমা কন্যা ১১ বছরের ভবতারিণীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। পরে ২৩ বছরের সদ্য বিবাহিত রবি নব পরিণীতা ভবতারিণীর নাম বদলে নিজের নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নাম রাখেন মৃণালিণী। যশাের থেকে ৩৮ কিমি আর খুলনা থেকে ১৬ কিমি দূরে যশাের-খুলনা জাতীয় সড়কের অনতিদূরে মৃণালিনীর পৈতৃক ভিটে দক্ষিণডিহি। খুলনা জেলার ফুলতলা উপজিলার সদর থেকে কিছুটা এগিয়ে ডানদিকে মােড় নিয়ে চার কিমি পথ পেরােলে একটি ভগ্নপ্রায় দোতলা বাড়ির সামনে ওই রাস্তার ইতি। ওই দালান বাড়িটিই রবিঠাকুরের শ্বশুর বাড়ি।
বিশ্বকবির শ্বশুর বাড়ি দেখতে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করতে খুলনা শহরের সদ্য পরিচিত রফিকুল ইসলাম খােকন তার লাল মারুতিতে আমাকে তুলে নিলেন। গন্তব্য দক্ষিণডিহি। খুলনার উত্তরে ফুলতলা পেরিয়ে ডানদিকের রাস্তা ধরে মাত্র আধ ঘণ্টায় দক্ষিণডিহি। গাড়ি থেকে নামতেই সামনেই দেখি পােড়া ইটের দোতলা ভবন। দোতলায় ওঠা বেশ ঝুঁকির। সামনের দিকে দরজা জানালা সব ভাঙা চোরা। আর বাড়ির পেছনের দিকে একটিও দরজা জানালা নেই। এসবের মাঝেও ভবনের সামনে আলাে করে দু’পাশে রয়েছে কবি ও কবিপত্নীর আবক্ষ মূর্তি। ভবনের পাশেই মাঠ। মাঠের পশ্চিমে মস্ত ঝাকড়া এক বকুল গাছ। বকুলতলা জুড়ে সিমেন্টের বাঁধানাে চাতাল। এখানে পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ কবি-স্মরণের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। ভবনের পেছনের দিকে কিছুটা দূরত্ব রেখে শৌচাগারটি এখনও টিকে আছে।। | ভবন থেকে অনতিদূরে বাড়ির উঠোনে কাটা বাঁশের ডালপালা সাফ করছিল এক বয়স্ক চাচা। আমাকে সঙ্গে নিয়ে রফিক ভাই। হাজির হল ওই চাচার কাছে। চাচাকে শুধােলাম রবি ঠাকুরের শ্বশুরালয়ের হাল হকিকত। বৃদ্ধ মাছু চাচা হাতের দা পাশে রেখে বলতে থাকে দক্ষিণডিহির কবির শ্বশুরবাড়ির ইতিবৃত্ত। তার কথায় দেশ ভাগের পরও দু-চার বছর কবির শ্বশুরের উত্তরাধিকারীর এই ভবনে কোনও মতে দিন গুজরান করেছেন। তারপর তারা কলকাতায় চলে যান। তখনও কর্মচারিরা ছিল। কর্মচারিরা পরে চলে যেতে বাধ্য হলে পাঁচ ভূতে দখল করে। অথচ সরকারের খাতায় প্রায় দশ বিঘে জমি সহ ভবনটি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত। সাম্প্রতিককালে কয়েকজন রবীন্দ্র অনুরাগীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় ভবন সহ কিছু জমি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। বকুল গাছের চারদিকে চাতাল, কবি ও কবি পত্নির আবক্ষ মূর্তি—এসব ওদেরই কাজ। যদি বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর ভবনটির সংরক্ষণের কাজে হাত দেয় তাহলে রবীন্দ্রস্মৃতির অবশেষটুকু টিকে থাকবে। অন্তত মাছু চাচার তাই আশা। তা হলেই হয়তাে অক্ষয় হবে এই এখানে রবি ঠাকুরের আবক্ষ মূর্তির নীচে তারই লেখায় ‘মাের নাম এই বলে খ্যাত হক, আমি তােমাদেরই লােক।
গৌতম কুমার দাস
0 Comments