Tarashankar Bandyopadhyay, the Bhumiputra novelist of Birbhum, wrote the legend of Hansuli Bank about the Kopai river. Later, famous film director Tapan Sinha turned the story into a film. I read this story several times and also watched the movie. The Kopai River flows in many places, but at the bend of the Banshabadi village near Lavpur, the Kopai River looks like a hammock.

দীর্ঘ আঠারো মাস যাবত ভ্রমণ পিপাসু মানুষ আমরা, আজ নিজেরা নিজেদের কাছে ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিচ্ছি। করোনা নামক এক ভয়ঙ্কর জীবাণুর ভয়ে সচেতন মানুষ নিজেদের যতোটা পারছেন সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করছেন। আমি ও আমার কাছে-দূরের প্রিয়জনেরাও করছি। মনে কিন্তু আর ভ্রমণ গল্প আসছিল না। ঘরে বসে ভ্রমণ কাহিনী লিখতে আমি অভস্থ নই। তাই কলম আর খাতা গুটিয়ে রেখেছিলাম প্রায় বছর খানেক। হঠাৎ এক অতি প্রিয় ও কাছের দাদার ছেলের বিয়ের আমন্ত্রণ পেলাম বোলপুর থেকে,  জুন মাসের শেষ সপ্তাহে বোলপুর রওনা দিলাম।

আমরা সকলেই প্রবীণ নাগরিক হবার দরুন প্রত্যেকেরই দুটো করে ইনজেকশন শরীরে ঢুকিয়ে ছিলাম, তার সার্টিফিকেট সাথে নিয়ে আর সব রকম সাবধানতা মেনে আমরা বৃষ্টি ভেজা এক দুপুরে পৌঁছেগেলাম বোলপুরে। 

এবার আমি আসছি ভ্রমণ কাহিনীতে। বোলপুরে আমাদের সকলেরই বহুবার আসা যাওয়া কারণ এখানে আমাদের অনেকেরই ডেরা আছে। যাই হোক খাওয়া দাওয়া করে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা পাঁচ বন্ধু চুপি চুপি বেরিয়ে পড়লাম হাঁসুলী বাঁকের সন্ধানে।

সেই কোপাই নদীকে নিয়ে বীরভূমের ভূমিপুত্র কথাসাহিত্যিক, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, লিখে ছিলেন হাঁসুলী বাঁকের উপকথা। পরবর্তী কালে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক তপন সিনহা এই গল্পটিকে চলচ্চিত্রে রূপান্তর করেন। আমার এই গল্পটি বেশ কয়েকবার পড়া ও চলচ্চিত্রটিও দেখেছিলাম। এই কোপাই নদী এঁকেবেঁকে অনেক জায়গায় চলেছে তবে এই লাভপুরের কাছে বাঁশবাদি গ্রামের বাঁকে এই কোপাই নদীর চেহারাটা যেনো হাঁসুলীর মতই লাগে ।

অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল রাত্রের হাঁসুলী বাঁক দেখার। তাই আজ চলেছি তার সন্ধানে। শান্তিনিকেতনের ডেরা থেকে তিরিশ কিলোমিটার এই পথ। প্রান্তিক স্টেশনকে টপকে কঙ্কালীতলাকে পাশে রেখে ছুটে চললাম লাভপুরের দিকে। পথে ফুল্লোরা মাকে প্রণাম করে, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিটেতে আর না গিয়ে সোজা হাঁসুলী বাঁকের দিকে এগোলাম। আলো কমে অন্ধকার বিস্তার করছিল। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁক ফোকর দিয়ে চাঁদটা ছুটে বেড়াচ্ছিল।

কাশ বনের মাঝখান দিয়ে কালো পিচের রাস্তা ধরে চাঁদের আলো আঁধারির দুষ্টুমি দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম বাঁশবাদি গ্রামে। গ্রামের সন্ধ্যা কি যে ভালো লাগে। ধুনোর গন্ধ, কয়লার উনুনের ধোঁয়ার গন্ধ ছেলেবেলার স্মৃতিকে মনে করিয়ে দেয়, তুলসী মঞ্চের প্রদীপের আলোয় গোবর লেপা উঠোন, এই সব দেখতে দেখতে মসৃণ রাস্তা ছেড়ে কাঁচা লাল মাটির পথ ধরে আরো এক কিলোমিটার টপকে সেই নয়নাভিরাম

জায়গায় পৌঁছালাম। জোনাকির সাম্রাজ্য। জোনাকির আলোয় হাঁসুলী বাঁক আমাদের বরণ করলো। বেহারা পাড়া এবং আটপৌরে পাড়া গুলো এক এক করে মনের গভীর থেকে বেরিয়ে এলো। চুপচাপ বসে আমরা পাঁচ বন্ধু এই নদীর রূপ দেখছিলাম। দূরের ইটভাটার টিম টিম করে জ্বলে থাকা শ্রমিকদের ঘর বাড়ি। কাহারদের উপস্থিতি আনুভব করছিলাম। কাহারদের দেবতা, কত্তা বাবার গল্প, ওনার বহন সেই বিষধর সাপটিকে গ্রামের ছেলে, প্রথম শ্রমিক করালীর হতে মৃত্যু, হাঁসুলী বাঁকের পশ্চিম দিকের সেই শিমুল গাছ, যেখানে কত্তা বাবা থাকতেন, সেই গাছটিকে কাছ থেকে দেখার ইচ্ছা আমার অনেকদিনের। নদীর ওপারে জঙ্গল। ঘন জঙ্গলের মধ্যে কেউ শিস দিচ্ছে মনে হচ্ছে হয়তো কোনো পাখি কিন্তু, আমদের মন তখন হাঁসুলী বাঁকের উপকথা গল্পের পাতায় পাতায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কি সুন্দর এই কোপাই নদীর ডাকনাম শাল নদী, ময়ূরাক্ষী নদীর থেকে এর জন্ম। যেমন সুন্দর এর চলন, তেমন সুন্দর এর হাঁসুলীর মত বাঁক, যেখানে প্রকৃতি উজাড় করে তার ভালোবাসা দিয়েছে। এটাকে একটা পর্যটন কেন্দ্র অবশ্যই করা যায়। আর হয়নি বলেই এত সুন্দর একটা জায়গা অবহেলায় নষ্ট হতে চলেছে। ছোট্ট কোপাই নদী ভয়ংকর বন্যায় এই বাঁশবাদী গ্রামকে খেয়ে ফেলেছিল। তবু আজও এই গ্রামে প্রতিটি কোণে খুঁজে পাওয়া যায় , করালী, বনওয়ারি, সুচাঁদ, বসন্ত, কালোশশী, সুবাসী, পাখি, মধুবালাদের। খুঁজে পাওয়া যায় একটি প্রকৃত প্রান্তিক গ্রাম। যে গ্রামে অনুভব করা যায় বর্তমানের ভাঁজে অতীতকে। আধুনিকতার প্রবাহতা বর্তমানকে ভবিষ্যৎগামী করলেও বর্তমান এগিয়ে চলেছে অতীতকে নিয়ে এখানে। তাই আজও আমার চোখে অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সবটাই আটকে আছে অতীতে। হাঁসুলী বাঁক নামটাই আমার বড্ড প্রিয়। স্মৃতি নদী বেয়ে রূপকথার পানসি চড়ে আমি হয়তো আজও বসে বসে মায়ের মুখে শোনা এই বীরভূমের সেই সরল মানুষদের জীবন, সেই বাগদি পাড়া, ডোম পাড়া, মাল পাড়া, কাহার পাড়ার ছবি দেখি তাই তো ছুটে আসি বারে বারে এই লাল মাটির দেশে। জোগাই গ্রামের আমার প্রতিটা নিশুতি রাত্রের পরতে পরতে লেগে থাকে ভূত, পেত্নী, ব্রহ্মদৈত্য ও তাদের আনাগোনা ও তাদের গল্প ।

আবার ফিরে আসছি কোপাই নদীর বাঁকে। বাঁশবাদী অতীত মুছে গেছে, শুধু পরে আছে বর্তমান, তাও সেই অতীতের চেহারায়, উন্নয়ন নেই। ভবিষ্যৎ কি হবে তাও জানিনা। পরে আছে কিছু অতীতের বৃদ্ধ গাছ, কিছু ভাঙ্গা মন্দির অার অতীত থেকে বর্তমান জানা ওই দূরের - হাঁসুলী রূপে কোপাই, ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। এখন শুধু বালি আর লাল ধুলো। হয়তো কাহারেরা পরিণত হয়েছে করালীর পথ ধরে কারখানা অথবা ইট ভাটার শ্রমিকে।

রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন রাখবো অন্তত একটা ওয়াচ টাওয়ার বানিয়ে দেওয়া হোক। যেখান থেকে এই কোপাই নদীকে হাঁসুলী মতই লাগবে। একটা থাকার জায়গা বানিয়ে কথাসাহিত্যিকের জন্ম ভিটে সহ এই ছোট্ট গ্রামটিকে পর্যটকদের কাছে আরো আকর্ষণীয় করে তুলুক। যেহেতু এখানে এখনও কোনো থাকার জায়গা নেই তাই শান্তিনিকেতনের থেকে এক, দেড় ঘণ্টা এই পথে এসে দেখে নেওয়া ভালো।

বোলপুরকে তো অনেক দেখেছেন একবার লাভপুরকে দেখে যান তবে শুধু কঙ্কালীতলা, ফুল্লোরা বা কথাসাহিত্যিক ভিটে নয়, সাথে হাঁসুলী বাঁকের উপকথা শুনতে হবে দেখতে হবে এর হাঁসুলী পরা রূপকে কোনো এক শীতের কুয়াশা মাখা সকালে বা বর্ষার সবুজ সজীব দুপুরে অথবা শরতের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘে ঢাকা চাঁদনী সন্ধ্যায়। 

পার্থময় চ্যাটার্জী