The fort was built by the Mughal Emperor Akbar between 1584 and 1583 AD. However, not only Akbar, but later Jahangir and Shah Jahan also have equal credit for the construction of this fort. The guide mentions that this fort is very defensive. If you cross a 20 meter high wall two and a half km long on three sides, you will be tested across 10 meters and then again 20 meter wall. Jamuna on the other hand.



রাতের যােধপুর এক্সপ্রেসে যাত্রা করলাম। পরদিন রাত ন'টা পনেরাে নাগাদ আগ্রা ফোর্ট স্টেশন নামলাম। বেশ জমজমাট স্টেশন। স্টেশন চত্বর থেকে একটা অটো ধরে চলে এলাম ছিপিটোলা চত্বরে। উঠলাম এক জনপ্রিয় বাঙালি হােটেলে। রাতেই ঠিক করে নিলাম আগামী কালের প্রােগ্রামটা। ম্যানেজারবাবু বললেন, হােটেল থেকে হাঁটাপথেই মিলবে আগ্রা ফোর্ট। আর দূরে নয়। পা বাড়ালেই আগ্রাদুর্গ আর বিশ্ববিখ্যাত তাজমহল। রাত আহারের পর তাই একটা চাপা উত্তেজনা নিয়ে ঘুমাতে গেলাম।

পরদিন সকালে বার হতেই প্রায় সাড়ে আটটা বেজে গেল। রাস্তায় নামতেই দেখি সারিবদ্ধ দোকানপাট। হােটেল, শপিংমল, লােকজন— সবমিলিয়ে জমজমাট বাজার। চলার পথে আগ্রার বিখ্যাত মিষ্টি পেঠা’র বেশ কিছু দোকান চোখে পড়ল। যদিও কেনাকাটা সাতসকালেই নয়। হাঁটতে-হাঁটতে দূর থেকে দৃষ্টিগােচর হল এক প্রাচীর। ওটাই দুর্গসীমা। পূর্বে দুর্গের চারটি ফটক থাকলেও, বর্তমানে দু’টি গেট খােলা। সামনের দিল্লী গেট সেনা জওয়ানদের জন্য সংরক্ষিত হওয়ায়, আরও কিছুটা হেঁটে দ্বিতীয় গেটে উপস্থিত হলাম। এই অমর সিং দরওয়াজাই পর্যটকদের জন্য অবারিত। টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম দুর্গের অভ্যন্তরে। ইতিহাসকে ঝালিয়ে নিতে সঙ্গে রইল এক অভিজ্ঞ গাইড। মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৬৪-১৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই দুর্গ নির্মাণ করেন। তবে শুধু আকবর নয়, পরবর্তীতে জাহাঙ্গির ও শাহজাহানও এই দুর্গ নির্মাণের সমান কৃতিত্বের অধিকারী। গাইড উল্লেখ করে এই দুর্গটি প্রতিরক্ষার দিক থেকে খুবই সুরক্ষিত। তিনদিকে আড়াই কিমি দীর্ঘ ২০ মিটার উঁচু প্রাচীর পেরােলেই ১০ মিটার জুড়ে পরিক্ষা তারপর আবার ২০ মিটার প্রাচীর। অন্যদিকে যমুনা। সবমিলিয়ে নিরাপত্তার আঁটসাটো ব্যবস্থা। হিন্দু ও মধ্যএশীয় স্থাপত্যের মেলবন্ধনে তৈরি এই দুর্গ ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড রেহিটেজ হিসাবে ঘােষিত।

গেট দিয়ে ঢুকে প্রথমেই জাহাঙ্গির মহল। পাশেই রয়েছে যােধাবাই মহল। সেখান থেকে এগিয়ে গেলেই খানিকদূরে শ্বেতপাথরের তৈরি শাহজাহানের খাস মহল। সামনেই সম্রাটের প্রিয় বাগান, অঙ্গুরিবাগ। সম্রাটের দুই কন্যার জন্য তৈরি পালকির আকৃতিতে গড়া দুই মহলও দেখার মতাে। অঙ্গুরিবাগের ধারেই মিনা মসজিদ। আরও খানিকটা এগিয়ে সম্রাট আকবরের দেওয়ানি আম, যেখানে তিনি প্রজাদের সঙ্গে দেখা করতেন। তার ঠিক পিছনেই দেওয়ানি খাস। যেখানে বিশেষ অতিথিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন সম্রাট। বিশ্বখ্যাত ময়ূর সিংহাসনটি ছিল এখানেই। পরে ১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দে পারস্যরাজ নাদির শাহ এটি লুট করে নিজ রাজ্যে নিয়ে যান। এরপর দেখলাম শিশমহল। যা ছিল আদতে বেগমদের স্নানঘর। ঘরের সারা দেওয়ালে লাগানাে রয়েছে ছােট ছােট কাচ, তাতে প্রতিফলিত হয়ে ঠিকরে পড়ত আলাে। দেওয়ান-ই-আম-এর অদূরে রয়েছে মােতি মসজিদ ও নাচানা মসজিদ। মসজিদ ছাড়িয়ে মিনা বাজার যা ছিল তখনকার মেয়েদের বিকিকিনির হাট। মােতি মসজিদের স্তাপত্যও মনােমুগ্ধকর। এবার চলে গেলাম অষ্টকোনী জেলখানা দেখতে। যেখানে শাহজাহান জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অতিবাহিত করেছেন। বন্দিদশায় এখান তেকেই তিনি অনতিদূরে অবস্থিত তাজমহল দেখতেন দু'চোখ ভরে। আমরাও অলিন্দের ভিতর থেকে তাজমহল দর্শন করলাম। তবে শাহজাহানের মতাে প্রেমিকের চোখে নয়, পর্যটকের দৃষ্টিতে। প্রায় ঘণ্টা তিনেক ধরে ইতিহাসের গন্ধ মেখে দুর্গের বাইরে এলাম। সেনা নিয়ন্ত্রিত থাকায় দুর্গের বাকী অংশে আর প্রবেশ করা গেল না। গেটের উল্টোদিকে এক রেস্তোরাঁয় ঢুকে চা-জলখাবার খাওয়া হল। এবার চলমান রাস্তা থেকেই একটা অটো ধরে নিলাম। প্রথমে চলে এলাম দয়ালবাগে। নির্মিয়মান রাধাস্বামী মন্দির দেখতে। ১৯০৪ সালে এই মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে আজও এর কাজ চলছে। মন্দির অভ্যন্তরে রয়েছে রাধাস্বামী সৎসঙ্গ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী শ্রী স্বামী মহারাজের সমাধিক্ষেত্র। সম্পূর্ণ শ্বেত পাথরের তৈরি এই মন্দিরের ভিতরের অংশের কাজ অসাধারণ। মন্দিরের চূড়ার কাজ এখনও চলছে। এর সম্পূর্ণতা পেতে আরও বেশ কয়েক বছর লেগে যাবে। ওখান থেকে এবার চলে এলাম সেকেন্দ্রায়। জায়গাটা মূল শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে। এখানে আছে ভারত সম্রাট আকবরের সমাধি। আকবর স্বয়ং এর নির্মাণ কাজ শুরু করলেও, শেষ হয় জাহাঙ্গিরের হাত ধরে। বিশাল কেয়ারি করা বাগিচা মাঝে অপূর্ব কারুকার্য খচিত এই সৌধ। চারতলা সৌধের তিনটি তল লাল পাথরের আর সর্বোচ্চ তলটি সাদা পাথরে নির্মিত। সমগ্র স্মৃতিসৌধটিতেই তার ধর্মীয় সম্প্রীতির নিদর্শন মেলে। টিকিট কেটে প্রথমে তােরণ চত্বরে। প্রবেশ পথের তােরণদ্বারের সৌন্দর্য ও শৈল্পীক কাজ দেখার মতাে। তােরণদ্বার থেকে সমাধিসৌধ যেতে কংক্রিটের রাস্তা। পথের দু’দিকের চত্বর জুড়ে সবুজ গাছপালা সম্বলিত উদ্যান। উদ্যান মাঝে হরিণের দল চড়ে বেড়াচ্ছে। এক দু'ঘণ্টা নয়, হাতে সময় নিয়ে সারাটা দিন এখানে কাটালে মন্দ লাগবে না। এক বিন্দু নয়নের জল/কালের কপােলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল/-এ তাজমহল। রবিঠাকুরের লেখা তাজমহলের এই বর্ণনা সেই কোন ছােটবেলায় পড়েছি। আজ এতদিন পড়ে সেই বিশ্বখ্যাত তাজকে স্বচক্ষে দেখতে যাচ্ছি। লাঞ্চের পরই অটো ধরে চলে এসেছি, তাজের দোরগােড়ায়। দুষণ রােধের জন্য মূল তােরণের আগে পর্যন্ত পেট্রোল-ডিজেল চালিত সমস্ত গাড়ির প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখান থেকে তাজ চত্বরে পৌঁছতে তাই রিক্সা, টাঙ্গা আর ব্যাটারি চালিত বাস চলে। সামান্য রাস্তা বলে অটো থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করি। অনতিদূরে দেখি টিকিট কাউন্টার। চটপট টিকিট কেটে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চেকিং পর্ব মিটতেই প্রবেশ করলাম তাজ চত্বরে। লালরঙের প্রধান ফটক পেরিয়ে পড়ন্ত সূর্যের সােনালি আলােতে প্রথম দেখা হল পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে নিজের অনুভূতিগুলাে সব কেমন ভেঙে আবার নতুন করে গড়তে শুরু করল। | বিহ্বল হয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম সেই সুন্দরের দিকে। মনে মনে ভাবছি কেন এতদিন এখানে আসিনি। তাজ ফটকের স্থাপত্যও মনােমুগ্ধকর। ফোয়ারার স্থির জলরেখাকে ডানদিকে রেখে, কেয়ারি করা রাস্তা ধরে চলেছি। ক্রমশ এগিয়ে আসছে যেন প্রেমের সমাধিটা। শােনা যায় তাজমহলকে সারাদিন বিভিন্ন সময়ে একটু ভালভাবে দেখলেই রঙের তারতম্য চোখে ধরা পড়ে। যেমন ভােরবেলায় তার ধূসর রঙ, সকালের আলােয় গােলাপি আভা। মধ্যাহ্নে রূপাের ঝিলিক, সূর্যাস্তে সােনালি রঙের বিচ্ছুরণ আর চাঁদের আলােয় সে যেন স্বপ্নের অলকাপুরী।

নীল ঢেউ তােলা যমুনার তীরে স্বপ্নের শ্বেতপাথরের স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করেন মুঘল সম্রাট শাহজাহান। যিনি মুঘল স্থাপত্যভাস্কর্যের শ্রেষ্ঠ পৃষ্ঠপােষক হিসাবে সুবিদিত। তার প্রিয়তমা পত্নী মমতাজের মৃত্যুর বছরই (১৬৩১ খ্রিষ্টাব্দ) এই প্রেমের সমাধিটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সর্বমােট কুড়ি হাজার শ্রমিক বাইশ বছর ধরে দিন রাত কঠোর পরিশ্রম করে এই সৌধ গড়ে তােলে। পার্সি, তুর্কি, ভারতীয় স্থাপত্যের মিশ্রণে নির্মিত এই অনন্য স্থাপত্যটির আনুমানিক নির্মাণ ব্যয় হয়েছিল তৎকালীন মূল্যে ৯ কোটি ১৭ লক্ষ টাকা। শুধু এদেশেই নয়, মধ্য এশিয়া থেকেও মজুরেরা এসেছিল এই বিশাল সৃষ্টির কর্মযজ্ঞে। ভালবাসার এই রাজপ্রাসাদের প্রধান স্থপতি ছিলেন ইরানের ঈশা খান। তিনি ওস্তাদ আহম্মদ লাহউরির নকশায় এই কাজ সম্পন্ন করেন। কিংবদন্তী, তাজমহলের একক দাপট বজায় রাখতে প্রধান স্থপতির হাত কেটে নেওয়া ও দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন শাহজাহান। প্রেমের সৌধটির বানানাের জন্য ৩৫ রকমের পাথর ব্যবহার হয়েছে দেওয়াল জুড়ে। ফতেপুরসিক্রি থেকে আনা হয় লাল বেলেপাথর, চিন থেকে আসে স্ফটিক। নীল প্রবাল আসে তিব্বত থেকে। রাজস্থানের মারকানা থেকে আনা হয় সাদা পাথর। অন্য বহু দেশের নানান প্রান্ত থেকেও নিয়ে আসা হয় অন্যান্য ব্যবহার্য সামগ্রি। এই মহান স্থাপত্যকে ফ্রেমবন্দি করতে আমি মাঠে নেমে পড়লাম। কখনও জুমে, কখনও ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে। ছবি তােলার বিরাম নেই।

তাজমহলের বাহ্যিক সৌন্দর্যে মােহিত হয়ে, এবার তাজ অন্দরে প্রবেশ করলাম। যেখানে চিরশায়িত রয়েছে মমতাজ ও ব্যথাতুর সম্রাট শাহজাহান। সেখানে এক আলাে-আঁধারী পরিবেশ। সমাধিক্ষেত্র জুড়ে ছড়ানাে গােলাপের পাপড়ি, জ্বলছে সুগন্ধি

ধূপ, তার সঙ্গে আতরের সুমিষ্ট সৌগন্ধ। এখানে আলাে জ্বালানাে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতি নিয়ত এখানে মােবাইল ও ক্যামেরার আলােয় আলােকিত হচ্ছিল সমগ্র সমাধিকক্ষটি। সূর্য পশ্চিমে অস্ত যেতেই কালাে হয়ে এলাে যমুনার জল। অস্পষ্ট হল শ্বেতমর্মর সৌধ। দক্ষিণা বাতাস দেহ ও মনে এনে দিল একটা শিরশিরানি অনুভূতি। তাজ চত্বরে বসে অপেক্ষা করছিলাম কখন উঠবে আকাশে চাঁদ। কিছুক্ষণের মধ্যেই উঠল সেই কাঙ্খিত দ্বাদশীর চাঁদ। চন্দ্রালােকিত শােভায় মায়াবি হয়ে উঠল চারপাশষ সত্যিই তাজকে দেখে মন ভরে গেল। উদাসী মনে বৈরাগ্য সংক্রামিত হওয়ার আগেই ফেরার পথ ধরলাম। কিন্তু একেবারেই পিছু ছাড়ছে না তাজ। পলক ফেলার আগেই, পিছনপানে চোখ চলে যাচ্ছে। আর জ্যোৎস্নালােকিত স্নিগ্ধ ছটার ঝিলিক তুলে, কেতাবি নেশায় সে পাগল করে তুলছে।

পরদিন মায়াবী পাহাড় বা নির্জন সমুদ্র সৈকতে নয়, গাড়ি ছুটলাে ইতিহাসের অমােঘ হাতছানি দেওয়া ফতেপুর সিক্রির দিকে। সেইমত সকালে হােটেলে চেক আউট করে বেরিয়ে পড়েছি। সামনে ঝাঁ-চকচকে টু লেনের পথ। গাড়ির স্পিড় মাঝে মধ্যে বাড়ছে, আবার কমছে। সবটাই পেশাদারি ড্রাইভারের মর্জির ওপরে। চটকদার হিন্দি গান চলছে, গাড়ির ভিতর। দুরন্ত গতিতে লরি-ট্রাক, প্রাইভেটকার পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। পরিবেশে একটা রুক্ষ-রুক্ষ অনুভূতি। এর মধ্যে রাস্তার এক ধাবায় চা-জলখাবার খাওয়া হল। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা চলে এলাম ফতেপুর সিক্রির দ্বারপ্রান্তে। আমাদের গাড়ি দাঁড়াল রাস্তার ধারে। এখান থেকে পাহাড়ি টিলার উপর ফতেপুর সিক্রি। এখানে ওপরে ওঠার জন্য লােকাল ট্যাক্সি নেওয়া বাধ্যতামূলক। সঙ্গে অবশ্যই একজন গাইড নিতে হবে। অতএব গাইডসহ চলে এলাম ফতেপুর সিক্রির দ্বারপ্রান্তে। বাতাসে ধুলাের আবির, গায়ে প্রাচীন ইতিহাসের গন্ধ, পরিবেশে পুরাতত্ত্বের ছড়ানাে নিদর্শন— এই প্রেক্ষাপটে টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম ইতিহাসের আঙিনায়। ১৫৬৯ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবর প্রতিষ্ঠিত ফতেপুর সিক্রি ছিল, তারই এক সময়কার রাজধানী। কিন্তু এই অনুপম স্তাপত্য শৈলী ছেড়ে, ১৫ বছর পর তিনি পূর্ব রাজধানীতেই ফিরে যেতে বাধ্য হন মূলত জলাভাবের জন্য। এই ফতেপুর সিক্রির আবার দুটি ভাগ। প্রথমে গাইড দেখাল সিক্রি। পরে দেখলাম ফতেপুর।

প্রথমভাগে গাইড দেখাল আকবরের প্রাসাদ, দেওয়ান-ই আম, দেওয়ান-ই খাস, হাওয়া মহল ইত্যাদি। আগ্রা দুর্গের সঙ্গে যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায় সিক্রির। এখানে প্রাসাদ স্থাপত্য শিল্পে, হিন্দু-মুসলিম মেলবন্ধন লক্ষ্যনীয়। অসাধারণ শিল্পনৈপুণ্যের  নিদর্শন হিসাবে এখানে দেখলাম, যােধাবাঈ প্যালেস, বীরবল প্যালেস, খাসমহল, রঙমহল ইত্যাদি। প্রাসাদের রন্ধনশালার দেওয়ালে কানের ঝুমকোর নকশাও বিশেষভাবে চোখ টানে। পাঁচমহলের স্থাপত্যশৈলীও অনবদ্য। ধাপে-ধাপে উঠে যাওয়া পাঁচতলা এই বাড়িতে ক্রমান্বয়ে ছােট হয়েছে উপরের তলগুলি। এছাড়া খ্রিস্টান বেগম মরিয়ণের গােল্ডেন প্যালেস, তুর্কি সুলতানার রেশম কোঠি, জ্যোতিষী ছত্রি, আস্তাবল, ট্যাকশাল ইত্যাদি স্থাপত্যকীর্তিও উল্লেখের দাবি রাখে। এরপর দেখে নিলাম দিন-ই-ইলাহীর প্রচারস্তম্ভ। যার মাধ্যমে আকবর মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সকল ধর্মকে। এই দৃষ্টান্তের প্রতিফলন শুধু ধর্মের ক্ষেত্রেই নয়, চিত্রশিল্পেও পূর্ণমাত্রায় প্রতিফলিত। তার বেশ কয়েকটা নিদর্শন গাইড আমাদের ঘুরে ঘুরে দেখালাে। এবার গাইড  দেখালাে নীল জলের মাঝে তানসেন মঞ্চ। এই মঞ্চেই বসত জমকালাে জলসা। আগমন হতাে বহু রথী-মহারথীর। শেষকালে গাইড দেখালাে দুর্গের বাইরে সবুজ গাছপালার মাঝে আকবরের প্রিয় হাতি হিরণের সমাধি সৌধ।

দ্বিতীয়ভাগটি মূল দুর্গের বাইরে বেশ কিছুটা উঁচুতে অবস্থিত। এর মধ্যে দেখলাম বিশ্বখ্যাত বুলান্দ দরওয়াজা। গুজরটি জয়ের স্মারক হিসাবে আকবর এটি নির্মাণ করান। ওই একই চত্বরে রয়েছে জামা মসজিদ। ও সেলিম চিস্তির দরগা। এখানকার ইতিহাস গাইডের মুখ থেকে শুনলাম একাধিক বেগম থাকা সত্ত্বেও নিঃসন্তান আকবর সন্তান কামনায় রাজস্থানের আজমির শরিফ যাওয়ার মনস্থ করলেন। কিন্তু যাত্রাপথে ফতেপুর নামে একটি অখ্যাত গ্রাম পড়ল। এখানে ছিলেন এক সুফি পির শেখ সেলিম চিত্তি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেকের অনুরােধে তিনি এই গ্রাম্য পিরের কাছে সন্তান কামনার আর্জি জানান। সম্রাটের মনােবাঞ্ছা পূরণ হবে এই আশ্বাসবানী শুনিয়ে চিস্তি আকবরকে আগ্রা প্রত্যাবর্তনের অনুরােধ জানান। এর কিছুদিন পরই যােধাবাঈ-এর গর্ভে জন্ম নেয় তার প্রথম পুত্রসন্তান। নাম রাখেন সেলিম। যিনি পরবর্তীতে হন সম্রাট জাহাঙ্গির। পিরের প্রতি সম্মান জানাতে আকবর তার রাজধানী এই ফতেপুর সিক্রিতে স্থানান্তরিত করেন। ১৫৭১ খ্রিষ্টাব্দে সেলিম চিস্তির মৃত্যুর পর সম্রাট এখানে এক সমাধিক্ষেত্র নির্মাণ করেন। লাল বেলে পাথরে তৈরি সৌধটি পরে জাহাঙ্গির শ্বেত পাথরে মুড়ে দেয়। এই দরগায় চাদর চড়ালে সকল মনােবাঞ্ছাই নাকি পূর্ণ হয়। সন্তান কামনার ক্ষেত্রে এই দরগার গুরুত্ব নাকি খুবই বেশি। চিস্তি চত্বরে এক চক্কর কেটে এবার নামতে থাকি। 

মানস মুখােপাধ্যায়