সিলেরি গাঁও উত্তরবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে গুরুত্ব অসীম পাহাড়ের গা বেয়ে ধাপে ধাপে ঘরবাড়ি, ফুলের সমারােহ, আর দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা। আকাশের অসীম প্রাচুর্য। ব্যস্ত শহরের আমাদের জন্য যা সবসময়ই এক লােভনীয় উপহার।
এই উপহারকে সঙ্গে নিয়েই আলগরা পর্যন্ত যাওয়া। আলগরাও বেশ প্রাচীন ও বর্ধিষ্ণ। দোকান বাজার-ঘরবাড়ি আর মানুষের ভিড় এখানেও। আলগরা ছাড়ালেই পথ অন্যমুখী। এই অন্যমুখ আমার জন্য প্রথমে সিলেরি গাঁওগামী। বেশ উঁচুনিচু দুর্গম পথ। যাকে বলে নির্ভেজাল পাহাড়ি অভিজ্ঞতা। সিলারি গাঁওয়ের উচ্চতা ৬০০০ ফুট। আলগরা থেকে কিছুটা পথ যাওয়ার পরই পিচ বাঁধানাে পথ বেঁকে গিয়েছে অন্য দিকে। আর একটি পথ সিলারি গাঁও গামী। গ্রাম্য সংস্কৃতির সারল্য আর সৌন্দর্য এখন পথ জুড়ে! এবার সেই সৌন্দর্যে অবগাহন। পৌছলাম যখন, তখন হিমেল বাতাস মুহূর্তেই বুঝিয়ে দিল তাপমাত্রার লক্ষণ— উঠে এসেছি অনেকটা উপরে—আকাশের অনেকটা কাছে। পাইনের ছায়াঘেরা সামনে অনেকটা খােলা অংশ। যেখান থেকে ধাপে ধাপে নেমে গিয়েছে। জঙ্গল। – জঙ্গল চিরে পথ— পথের পাশে ছােট ছােট গ্রাম। আমার তিনদিনের সিলারি গাঁও বাসের ঠিকানা, মি তামাং-এর হােম স্টে। কাঠের ঘরবাড়ি, চারপাশে প্রচুর ফুল আর নানা জাতের চেনা অচেনা গাছ। কাঞ্চনজঙ্ঘা অনেকটা কাছ থেকে ধরা দেয় এখানে। তবে প্রকৃতির দয়া হলে তবেই। আকাশ খুব পরিষ্কার হলে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন। এই দর্শন যে প্রায় ঈশ্বর দর্শনের মতােই মনােলােভা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সিলারি গাঁও এক গ্রাম। জনসংখ্যা দু’শােও নয়। মুলত চাষবাস। ইদানীংকার পেশা ‘হােম স্টে’ ব্যবসা। শহুরে আরামের আয়ােজন নেই বললেই চলে। তবে ঠাণ্ডায় গরম জল বা গরমা গরম খাবার বা পানীয়ের আয়ােজনে ত্রুটি নেই। স্বাদ বদলে মােমাে, নুডলস যেমন আছে, তেমন মন চাইলে পাবেন নানা স্বাদের পকোড়া। এসব হল সান্ধ্য আড্ডার আয়ােজন। চা, কফি ছাড়া উষ্ণ পানীয়ের সন্ধানও রয়েছে। অতিথিবৎসল হােম স্টের মালিককে বললেই উপাচারসহ হাজির। ডাল, সবজি, ডিম, চিকেন, ভাজাভুজি, স্যালাড, ভাত ও রুটি পাবেন লাঞ্চ ও ডিনারে। ব্রেকফাস্টে পুরি, আলু পরােটা বা টোস্ট অমলেট। কাঠের আগুনে রান্না, ডাল। গরম সবই অর্থাৎ বাঁচার আয়ােজনে প্রকৃতিই ভরসা! তিনদিনের বসবাসে বার বার উপলব্ধি করলাম এই তত্ত্ব প্রকৃতি যেমন ওদের ঘিরে থাকে মায়ের মতাে, তেমন ওরাও বাঁচে সেই মায়ের মুখের দিকে চেয়েই। রাষ্ট্রের আনুকুল্য বর্জিত সভ্য সমাজ থেকে অনেক দূরের এই ছােট্ট পাহাড়ি গ্রামের মানুষগুলির হৃদয় ও মস্তিষ্ক পরমা প্রকৃতির মতােই সরল, উদার ও চাহিদাশূণ্য। কত অল্পে খুশি, দেখে অবাক হয়েছি, অনুপ্রাণিত হয়েছি। সামান্য চাষবাস, মুরগি পালন—তাকে ঘিরেই খানাপিনার আয়ােজন ও জীবিকা। নারী-পুরুষ এমনকী পরিবারের শিশুরাও ব্যস্ত। ছােট ছােট কটেজের শােভা দেখে মুগ্ধ আমরা। ওরা উদয়াস্ত খাটে তার পরি ট্যুরিস্টরা যেন পূর্ণ আরাম পান, যাবতীয় সীমাবদ্ধতার মধ্যেই। ফুলের মতােই চঞ্চল, উজ্জ্বল আর সদা খুশি এখানকার শৈশব। গায়ে সােয়েটার পর্যন্ত নেই অনেকের, ঠাণ্ডায় জড়ােসড়াে, যাবতীয় কষ্ট দূরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা হাসিমুখের চেষ্টায়। একটু ভালবাসলেই কাছে আসে ওরা, মন খুলে কথা বলে। ফিরিয়ে দেয় অনেকটা খুশি, যা প্রাণিত করে প্রতিটি মুহূর্তে। অন্তহীন দারিদ্র, নিরন্তর সমস্যা সঙ্কটে জর্জরিত মানুষগুলি কী বিস্ময়করভাবে বাঁচিয়ে রাখে তাদের অন্তরের সম্পদ। মনুষ্যত্ব, সততা আনন্দ এবং পারস্পরিক সাহচর্য, সহমর্মিতা। যতবার আসি, ততবার শিখি।
অলস বেলাগুলি কাটতে থাকে সারাদিন প্রকৃতি দর্শনে। চারদিকে রাত ঘন হয়, স্তব্ধতা নামে। ঝকমকে আকাশে অষ্টমীর চাদ—তারারাও হাজির ছড়িয়ে ছিটিয়ে। দেখতে দেখতে সম্মােহন। সেই সম্মােহন নিয়েই ঘুমের দেশে যাত্রা। পরদিন সকাল হতেই বেরিয়ে পড়ি— রমিতি ভিউপয়েন্ট আর সাইলেন্স ভ্যালি দেখার পরিকল্পনা নিয়ে। রমিতির উচ্চতা আরও একটু বেশি। কিছুদূর গাড়িতে গিয়ে, বাকিটা পায়ে হেঁটে যেতে হয়। কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ অনেকটা বিস্তারে দেখা যায় এখান থেকে। দেখা যায় কালিম্পংএর দেলাে। সিকিমের বেশ কিছুটা আর তিস্তা। উপর থেকে তিস্তাকে মনে হয় চওড়া এক ফিতের মতাে। ক্যামেরায় ধরা পড়ে তার রহস্যময়ী রূপ। তিস্তাকে যেখান থেকেই দেখ, এই রহস্য যেন ফুরােবার নয়। রমিতে থেকে সাইলেন্স ভ্যালি। অসাধারণ সবুজের এক উপত্যকা। চারদিকে পাইনের প্রাচুর্য— মাঝে সবুজ মখমলের আভিজাত্য। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে, মনে হয় স্বর্গ’ এটাই। কিছুই যেন হল না দেখা। চিত্ত জুড়ে অসন্তোষ। তার মধ্যেই তৃপ্তি ও সুখ। এরই মধ্যে এক হিম হিম সকালে দেখা পেয়েছি অপরূপ কাঞ্চনজঙ্ঘার। ঘুম চোখে এক ছুটে শুধু দৃষ্টিতেই তাকে ছুঁয়ে যাওয়া। এই কি কম ভাগ্য!
পেডং-এর উচ্চতা কিছুটা কম। সিলারি গাঁও থেকে আবার যাত্রা সেই উঁচু নিচু পথ ধরে। কখনও পাশে গভীর খাদ। অন্য পাশে সারি সারি পাহাড় অহংকারে দীপ্ত। আমি তুচ্ছ মানুষ এই সব দেখতে দেখতেই পেডং গামী। এরই মধ্যে ড্রাইভারের কাছ জানা অঞ্চলটি সম্পর্কে নানা তথ্য। রাস্তাঘাট না হলে কিছুতেই পুষ্ট হচ্ছে না এখানকার পর্যটন ব্যবসা। কাছাকাছি প্রচুর স্পটের কথাও জানায় সে। তিলচুলে ভিউ পয়েন্ট, ঋষিখােলা, রিকিসান ভিউ পয়েন্ট, জামসাং ফোর্ট, পেডং মনাস্টারি, ক্রশহিল, ঋষি নদী, লাভাস লােলেগাঁও, ঋষপ, জুলুক, আরিটাল, গ্যাংটক এবং আরও অনেক। শুনি আর লােভী হয়ে উঠি। মনে মনে স্বপ্নরা ডানা মেলে, আসতে হবে আবার, বার বার।
এই স্বপ্ন স্বপ্ন মন নিয়েই পেডং। ছােট্ট বর্ধিষ্ণ শহর। উচ্চতা ৪০০০ ফুটের একটু বেশি। ঐতিহাসিক সিল্করুটের ধারেই এর অবস্থান। এখানে পৌছে ক্রশহিল পয়েন্টে হােম স্টে। তিনমাথার মােড়ের এই ছােট্ট দোতলা বাড়িটি হল আমার পেডং-এর ঠিকানা। লাগেজ রেখে ঘরের জানলা খুলতেই পাহাড়ের দর্শন। পর পর সারি সারি। জানলাম সেই সব পর্বতমালারা সবই সিকিমের অন্তর্ভুক্ত। ভৌগলিকভাবে পেডং সিকিম বর্ডারের কাছাকাছি। তাই সিকিমের অনেকটা দেখা যায়। জানলায় চোখ রাখলে, ব্যালকনিতে দাঁড়ালেই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়ে ওঠা গ্রাম-শহর-জনপদ। রাত নামলে মিটিমিটি আলাে জ্বলে সেখানে। আকাশের তারাদের সঙ্গে মাটির পৃথিবীর সেই সব আলােরা বার্তা বিনিময় করে। নির্জন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শুনি সেই বার্তা। ক্লান্ত দিন শেষ হয় সেই চেনাচেনির মন দেওয়া নেওয়ার খুশির বার্তা নিয়েই।
সকাল হলেই বেরিয়ে পড়া। চড়াই-উতরাই পথ। পথের ধারে ফুলের উৎসব, ছােটবড় গাছ। আর শ্রমজীবি মানুষ। মাথায় কাঠের বােঝা নিয়ে এক বালক। মনের ক্যামেরায় তার যাবতীয় অভিব্যক্তি বন্দি করে আমিও এগােই পায়ে হেঁটে। আর একটু সামনে | যেতেই ক্যানভাসটা হঠাৎই বদলে যায়। অনেকটা বিস্তারে প্রকৃতি যেন খুলে দিয়েছেন তার হৃদয়ের সব দরজা। ঝকঝকে আকাশ। | সব ছাড়িয়ে দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা! পথ বাঁক নিয়ে আরও এগিয়ে গিয়েছে আর সেই বাঁকেই বহু পুরনাে এক চার্চ। চার্চে ক্রুশবিদ্ধ যিশু
দাঁড়িয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। একটু আগে দেখা মানুষটিকে মনে পড়ল। ইতিহাস বদলাতে পারলাম না আমরা আজও। পেডং বাসের মেয়াদও ফুরলাে শেষে। সেই ভরা ঝুলি নিয়েই এবার ফেরার পালা। যেতে যেতে একলা পথে আবার দেখা তিস্তার সাথে। উঁচু উঁচু পাহাড় ছুঁয়ে এঁকে বেঁকে যেতে যেতে সেও জানায় বিদায়— বিদায়ের সুর বাজে পথ প্রান্তর জুড়ে।
0 Comments