April 14, 1944 The first national flag of independent India was flown at Mairang in Manipur. Subhash Chandra Bose, one of the leaders of India's liberation struggle, went abroad and formed the Azad Hind Fauj for the independence of his country. It was his Azad Hind Fauj that liberated this place from British rule.
১৯৪৪, ১৪ এপ্রিল। স্বাধীন ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকা ওড়ানাে হল মণিপুরের মৈরাঙের মাটিতে। ভারতের মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম নেতা সুভাষচন্দ্র বসু দেশের বাইরে গিয়ে স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য গঠন করেছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ। তার এই আজাদ হিন্দ ফৌজই বৃটিশ শাসন থেকে মুক্ত করেছিল এই স্থানটি। ১৯৪৪ এর বসন্তকালে শুরু হল অভিযান। আজাদ হিন্দ ফৌজে তখন হাজার বারাে সৈন্য। এই সৈন্য দিয়েই গঠিত হল চারটি ব্রিগেড — কর্ণেল শাহ নওয়াজের অধীনে সুভাষ ব্রিগেড, কর্ণেল ইয়ান্য কিয়ানির অধীনে গান্ধী ব্রিগেড, কর্ণেল মােহন সিং-এর অধীনে আজাদ ব্রিগেড আর নেহেরু ব্রিগেড কর্ণেল ধীলনের অধীনে। এঁরা চারদিক থেকে মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল আক্রমণের জন্য তৈরি। আসলে রাজনৈতিক দিক থেকে ইম্ফলের গুরুত্ব ছিল যথেষ্ট।
২৮ এপ্রিল কর্ণেল শাহ-নওয়াজ নেতাজীর কাছে ইম্ফল আক্রমণের অনুমতি চাইলেন। নেতাজী জানালেন আজাদ ব্রিগেড আর গান্ধী ব্রিগেড ইম্ফল আক্রমণ করছে, সুভাষ ব্রিগেডও যেন তৈরি থাকে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে ইম্ফল হস্তগত হবে এবং শাহ নওয়াজকে যেতে হবে ব্রহ্মপুত্রের পারে। তিনি রওনা হলেন কোহিমার দিকে। ব্রহ্মদেশের দুর্গম অরণ্যে ম্যালেরিয়ার আক্রমণেও সৈন্যদের উদ্যম নষ্ট হয়নি। কোহিমায় জাপানীরা নয়, যুদ্ধ করেছিল ভারতের মুক্তি সংগ্রামী আজাদ হিন্দ ফৌজ। আর এই যুদ্ধে নাগারা তাদের সর্বতােভাবে সাহায্য করেছিল। ইংরেজদের উপর নাগাদের রাগ ছিল দীর্ঘদিনের। কারণ তাদের মুক্তিসংগ্রামের নেতা রানী গুইন্দালােকে বন্দী করেছিল ইংরেজরা।
তবু ভারতের ইতিহাসে আজাদ হিন্দ ফৌজের পাশাপাশি মৈরাঙের নাম ভাস্বর হয়ে থাকবে চিরকাল। ইম্ফল থেকে মাত্র পঁয়তাল্লিশ কিলােমিটার দূরে এই শহরটির অবস্থান। মৈরাঙ বাজার যেখানে শেষ হয়েছে তারই বাঁদিকের পথ ধরে একটু এগােলেই দেখা যাবে একটি দোতলা বাড়ি – যার প্রাঙ্গণে আই.এন.এ. মেমােরিয়াল। এ জায়গাটিকে মৈরাঙের মার্টার্স মেমােরিয়াল গ্রাউণ্ড বলে। বাড়িটির দোতলায় আই.এন.এ.ওয়ার মিউজিয়াম আর একতলায় নেতাজী লাইব্রেরী। মিউজিয়ামটি উদ্বোধন করেছিলেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৬৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। বহু মূল্যবান ছবি, চিঠিপত্র, আজাদ হিন্দ বাহিনীর কর্ণেল ও লেফটেন্যান্টদের বিবিধ ব্যাজ এখানে রয়েছে। নেতাজীর শেষ ছবিটি যেটি সাইগনে তােলা হয়েছিল ১৯৪৫ সালের ১৭ অগস্ট সেটিও স্থান পেয়েছে এখানে।
এই ভবনটিতে ঢুকতেই চোখে পড়বে সাজানাে বাগানে রয়েছে নেতাজীর মানুষ সমান ব্রোঞ্জের স্ট্যাচু। ১৯৭২ সালের ২১ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরি এই মূর্তির আবরণ উন্মােচন করেন। অন্যদিকে রয়েছে একটি পাথরের স্তম্ভ, যার গায়ে লেখা আছে – ইত্তেহাদ, ইত্যাদ ও কুবানি। নেতাজী সিঙ্গাপুরে যে আই. এন.এ. মেমােরিয়াল স্থাপন করেছিলেন ইংরেজরা তা ভেঙ্গে দিয়েছিল। ঠিক সেইরকমই একটি স্মৃতিস্তম্ভও এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
শুধু ইতিহাস নয় মৈরাঙের অন্যতম আকর্ষণ লােগতাক লেক এবং কৈবুল লামজাও জাতীয় উদ্যান। আর এই লােগতাক লেককে কেন্দ্র করে রােমিও জুলিয়েটের রােমান্টিক কাহিনীর মতােই খাম্বা-থইবির লােক কাহিনী আজও মৈরাঙের বাতাসে ভেসে বেড়ায়। বরাহের রূপ ধারণ করে ভগবান থাং জিং মর্ত্যে এসেছিলেন এবং তারই হাতে সৃষ্টি মৈরাঙে। কিন্তু কলিযুগের প্রথম রাজার সুশাসনের ফলে মানুষ ভুলে যায় থাং জিং কে। সেই প্রথম রাজার নাতি যখন মৈরাঙের রাজা তখন খাম্বার বাবা তাকে শিকারকালীন অবস্থায় বাঘের হাত থেকে রক্ষা করেন। এই রাজার ভাই যুবরাজের একমাত্র কন্যা ছিলেন থইবি। সুন্দরী থইবির একদিন ইচ্ছা হলাে লােগতাক লেকে সখীদের নিয়ে তিনি মাছ ধরবেন। রাজা তেঁড়া পিটিয়ে সমস্ত পুরুষের সেদিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ করলেও খাম্বা সে কথা জানতাে না। ফলে সুন্দর বলিষ্ঠ খাম্বাকে দেখে রাজকন্যা মুগ্ধ হলেন ও খাম্বার প্রতি অনুরক্ত হলেন। এদিকে থইবির বিবাহ ঠিক হয়ে আছে ধনী যুবক নঈবানের সঙ্গে। স্বাভাবিকভাবেই খাম্বাকে নঈবানের সঙ্গে নানা প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হয়, একটার পর একটার শক্তি পরীক্ষা দিতে হয়। পাগলা ষাঁড়কে বশ করা, হাতির পায়ের তলা থেকে বেঁচে ফিরে আসা প্রভৃতি নানা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর যখন থাবােন বাঘের হাতে মারা গেল তখন অবশেষে খাম্বা আর থইবির আকাঙিক্ষত মিলন হলাে।
কিন্তু বিবাহিত জীবনে খাম্বার মনে হতে লাগলাে থইবি তাকে প্রকৃতই ভালােবাসে কিনা জানা প্রয়ােজন। এদের সমাজে প্রিয় নারীকে ঘর থেকে বাইরে বার করে আনার এক অদ্ভুত প্রথা ছিল। মেয়েটি যখন একলা ঘরে থাকবে তখন পুরুষটি ঘরের বাইরে থেকে বেড়ার ফাক দিয়ে একটি লাঠি ঢুকিয়ে দেবে। যদি সেই বিবাহিত মেয়েটি লাঠিটি চেপে ধরে তাহলে বাইরের পুরুষটি বুঝে নেবে যে তার সম্মতি আছে। একদিন গভীর রাতে থইবি দেখল তার ঘরে কেউ লাঠি ঢুকিয়েছে। বিরক্ত এবং ক্রুদ্ধ থইবি কোনাে কথা না বলে খাম্বার বর্শা নিয়ে সােজা ঢুকিয়ে দিল বেড়ার বাইরের মানুষটার বুকে। যন্ত্রণায় কাতর খাম্বা চেঁচিয়ে উঠল – থইবি, আমি। আমি খাম্বা। পাগলের মতাে বাইরে বেরিয়ে এসে থইবি দেখল রক্তে ভেসে যাচ্ছে খাম্বার সারা শরীর। সে আর দেরী না করে ওই বর্শা টেনে নিয়ে বসিয়ে দিল নিজের বুকে। দু'জনেরই মৃত্যু হলাে একই সঙ্গে। এক রােমান্টিক ট্র্যাজেডির নিমর্ম উদাহরণ খাম্বা-থইবি। মণিপুরী সাহিত্যেও এই কাহিনী স্থান করে নিয়েছে তার আপন বৈশিষ্ট্যে।
যে লেকের জলে খাম্বা-থইবির প্রথম চার চোখের মিলন হয়েছিল সেটি আই.এন.এ. মেমােরিয়ালের সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে অবস্থিত। অথাৎ মৈরাঙ বাজার থেকে যে রাস্তাটি ডান দিকে গেছে সেটিই পৌঁছে দেবে লােকে । রিক্সা, মােটরগাড়ী এবং ট্যুরিস্ট বাসও সহজেই যেতে পারে এ পথে। পথের ধার দিয়ে নালার মতাে নদী বয়ে চলেছে। ছােটো ছােটো ডিঙি দিয়ে নৌকোয় যাতায়াত করছে মেয়েরা। এই বিস্তীর্ণ লেকের মাঝে আছে ছােটো ছােটো দ্বীপ আর পাহাড়। বর্তমানে এখানে প্রায় দু’শাে ঘর মানুষের বসবাস। সেন্দ্রা দ্বীপের উপর থেকে লােক লেকের প্রাকৃতিক দৃশ্য অসাধারণ। সবুজাভ নীল পাহাড়ে নীচে যে বিশাল এলাকা জুড়ে জলরাশি, সেখানে কচুরিপানা তার সবুজ বেগুনির কার্পেট বুননে যেন নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে শিল্পীর সামনে। লােগতাকের দক্ষিণ-পশ্চিমে পৃথিবীর অন্যতম ভাসমান পার্কটিই কৈবুল লামজাও জাতীয় উদ্যান। বিভিন্ন জাতের হরিণের মধ্যে সাংগাই হরিণ যাকে নৃত্যরত হরিণ বলা হয় – সেটিই এই পার্কের প্রধান সম্পদ। এছাড়াও অন্যান্য হরিণ, পরিযায়ী পাখি, বনবিড়ালের দর্শন মেলে নভেম্বর থেকে মার্চ মাসের মধ্যে। বন দফতরের তত্ত্বাবধানে এখানেও রয়েছে দুটি বিশ্রামাগার। আর উৎসুক ভ্রমণার্থীদের আকর্ষণ করবে ইম্ফলে গােবিন্দজীর মন্দির, ইমা বাজার (মহিলা পরিচালিত), শহীদ মিনার, ওয়ার সিমেট্রি, জাতীয় মিউজিয়াম, অর্কিড হাউস প্রভৃতি।
0 Comments