This time I am going on a new offbeat trip on Doors. The name of this new Rupnagar is 'Lal Jhamela Basti'.
এবারের ডুয়ার্স সফরে আজব নামের নতুন এক অফবিট ভ্রমণে চলেছি। মন চলাে যাই ভ্রমণে, দুটো দিন রইব সেথায় নির্জনে। নতুন এই রূপনগরের নাম ‘লাল ঝামেলা বস্তি”। আজব নামই বটে। ভ্রু কুঁচকে দ্বিতীয়বার বলতে হয় নামের এমনই বাহার।
নিউ মাল জংশন থেকে বেরিয়ে এন এইচ ৩১ সি ধরে ঝা চকচকে পিচ সড়কে গাড়ি লম্বা দৌড়ে একে একে পেরিয়ে চলল মালবাজার, চালসা, নাগরাকাটা। এ এক মন ভরানাে চোখ জুড়ানাে ডুয়ার্স যাত্রা। সবুজের কত যে রকমফের, কত যে রংবাহার এ পথের দুপাশের পাহাড়-জঙ্গল-চা বাগান দেখতে দেখতে গেলে দু’চোখে তা ধরা পড়বেই। এ এক গ্রিন করিডর, সবুজে সবুজ চারপাশ। নিউ মাল জংশন থেকে লাল ঝামেলা বস্তি ৪০ কিলােমিটার। জলপাই সবুজ বােলেরাে গাড়িতে দুরন্ত বেগে ছুটতে ছুটতে কখন যেন জলঢাকা নদী, গাঠিয়া ব্রিজ পেরিয়ে চলে এলাম লুকসান মােড়ে। এখানে এসে রাস্তা দু'ভাগ হয়ে গেছে। সােজা চলে গেলে বানারহাট, বিন্নাগুড়ি, ধরণীপুর। অন্য পথটা কালীঘােলা সেতু টপকে একটু ঘিঞ্জি এক ছােট্ট জনপদকে অতিক্রম করে পৌছে যেতে হয় এশিয়ার বিখ্যাত চ্যাংমারি চা বাগানের সামনে। অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা এই বাগান পথ এঁকে বেঁকে গিয়ে শেষ হয়েছে। ডায়না নদীর ধারে। এটাই লাল ঝামেলা বস্তির শান্ত, ছােট্ট গ্রাম। আদিবাসী ওঁরাও, মুন্ডা, নেপালী, বিহারী ও অল্প কিছু বাঙালি নিয়ে গড়ে উঠেছে এই জনপদ। এখানে মানুষের প্রধান জীবিকাই হল চা-বাগানের কাজ।
ডায়না নদী, ভুটান পাহাড় ও চা বাগানকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে পর্যটনের নতুন ঠিকানা—‘লাল ঝামেলা বস্তি ইকো রিভার ক্যাম্প’। ঝকঝকে নতুন বাহারি দু’টো কটেজ, সেখানে চারটে ডাবল বেড রুম। প্রতিটি ঘরেই আধুনিক সুব্যবস্থা। প্রশস্ত এক কিচেন কাম ডাইনিং হল। সামনে লম্বা লম্বা সুপুরি গাছে ঘেরা এক ছােট্ট ফুলের বাগান। পিছনে দুটি পাতা, একটি কুঁড়ির সবুজ চা বাগান। আর হাত বাড়ানাে দূরত্বে ডায়না নদী ও ভুটান পাহাড়। কটেজের বারান্দায় বসে এসব খুব উপভােগ করা যায়। দু’টো দিন নির্জনে, নিভৃতে দিলখুশ হয়ে যাওয়ার এ এক অফবিট মুসাফিরখানা।
লাল ঝামেলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ডায়না নদী। অনেকটা ছড়ানাে দীর্ঘ আঁকাবাঁকা এই পাহাড়ি নদীর বয়ে চলা দারুণ উপভােগ্য এক দৃশ্য। কুলকুল শব্দে নীলস্বচ্ছ জল অবিরত বয়ে চলেছে। জলের তলায় নুড়ি পাথর ও কুঁচো মাছ স্পষ্ট দেখা যায়। নদীর বুকে নেমে কোনও এক পাথরে দু’দন্ড চুপটি করে বসে চারপাশের নিসর্গ দেখার আনন্দ অলীক অপরূপ মনে হবে।
নদীর পাড় ধরে হেঁটে হেঁটে দারুণ সুন্দর ঝুলন্ত ডায়না ব্রিজের উপর দিয়ে ভুটানের সীমানায় চলে যাওয়ার মজাই অন্যরকম। সেখানে গিয়ে চা-মােমাে খেয়ে ভুটানিদের সঙ্গে দুটো গল্প করে অনায়াসে ফিরে আসা এক স্মৃতিময় মনােরম ভ্রমণ।
ঝুলন্ত ডায়না নদী ব্রিজেরই তলায় দেখা যাবে স্বচ্ছ নীল জলে ঝক ঝক মাছ দৌড়ে-খেলে বেড়াচ্ছে। এইসব মাছকে ওরা পবিত্র জ্ঞানে বাঁচিয়ে রেখেছে। কেউ ভুলেও এই মাছ ধরে না। নদীর টলটলে জলে মাছেদের এই চঞ্চলতা আমাদের শরীর মনেও দোলা দিয়ে যায়।
ডায়না নদীর ওপারে ভুটান পাহাড়। পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে রাস্তা চলে গেছে, সে রাস্তা ধরে চলে যাওয়া যায় সামচি, চামুর্চি, কিরনা, মেচোড়। ভুটান আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র। বন্ধুত্বসুলভ সহজ সখ্যতায় আলাপ হয়ে গেল ডায়না রিভার ব্রিজে পাহারাদার ভুটানি পুলিশ মানুষটার সঙ্গে। নাম তার করমা ওয়াংদি। গােলগাল ফর্সা চেহারা। তাঁর থেকে জানলাম, এই ব্রিজের ভুটানি ভাষায় নাম খেফেনজম আমরা বলি, ডায়না রিভার ব্রিজ। ব্রিজটি ৩৭৫ মিটার লম্বা। খুবই নান্দনিক এক ঝুলন্ত ব্রিজ। এই ব্রিজে দাঁড়ালে চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ বললে কম বলা হয়। মায়াবী মুগ্ধতায় মনটা আচ্ছন্ন হয়ে যায়। চারপাশে বৌদ্ধ ধর্মপতাকা পত পত করে উড়ছে। উজ্জ্বল নীল আকাশ, মিষ্টি রােদুর— সব মিলিয়ে দারুণ উপভােগ্য এক দৃষ্টিসুখের উল্লাস।
ব্রিজের উপর দিয়ে দল বেঁধে মিষ্টি মিষ্টি ভুটানি বালিকাদের যাতায়াত খুবই দেখা যায়। কারণ এ পথে মেয়েদের একটি স্কুল রয়েছে। হাসিখুশি নম্র বালিকারা একটু লাজুক হলেও সুন্দর হেসে কথা বলে। অনুমতি নিয়ে ছবি তুলতে চাইলে কখনও ‘না’ বলে । লজ্জায় মুখ লুকোয় না। ছবি তােলা হলে হেসে ‘থ্যাঙ্কইউ’ বলে।।
নদী, পাহাড়, ঝুলন্ত ডায়ানা ব্রিজের পরেই আরও এক চোখ জুড়ানাে, মন মাতানাে ভ্রমণ হল চ্যাংমারি চা বাগান। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ এক চা বাগান। এই বাগানে লেপার্ড ও ময়ূরের দেখা পাওয়া যায়। হর্নবিল বা ধনেশপাখি, বনটিয়া, ময়না পাখিরও দেখা মেলে। চ্যাংমারি চা বাগানের এক প্রান্তে রয়েছে সীমা সুরক্ষা বল এর ক্যাম্প। এঁরাই সর্বদা পাহারাদারের ভূমিকায় থাকে।
লাল ঝামেলা বস্তি থেকে দিনে দিনে ঘুরে বেড়িয়ে ফিরে আসা যায় এমন সব অপূর্ব সুন্দর জায়গা রয়েছে চারপাশে। লাল ঝামেলা থেকে লুকসান মােড় হয়ে খুনিয়া মােড় মাত্র ২৩ কিলােমিটার। ঘুনিয়া মােড় হল এক গােল্ডেন ট্যুর পয়েন্ট। এখান থেকে ছড়িয়ে পড়েছে কত রাস্তা চারিদিকে। ঘুনিয়া মােড় থেকে জঙ্গলের রাস্তা ধরে মূর্তি নদী মাত্র ০৬ কিমি, গরুমারা ১২, লাটাগুড়ি ২৪, চাপড়ামারি ০২, ঝালং ২৫, বিন্দু ৩৭, প্যারেন ৩২ কিলােমিটার। ডুয়ার্সের রঙিন আলখাল্লায় এরা সবাই হল এক একটা জেল্লাদার মণিমানিক্য।
লাল ঝামেলায় শীত ও বর্ষা দুইই খুব উপভােগ্য। পাহাড়ি ঠাণ্ডায় শীতের মিঠে রােদুর গায়ে মেখে মনমাতানাে ভ্রমণ করা যায়। আর বর্ষায় থাকে ডায়না নদীর প্রবল জলােচ্ছাস দেখার মতাে বর্ষাফুর্তির আনন্দ। চ্যাংমারি চা বাগান, ভুটান পাহাড়ি বর্ষায় ধুয়ে মুছে সবুজ আরও সবুজ হয়ে ওঠে। সবুজের সে বাহার দুচোখে আবেশ এনে দেয়, মনটা ভরে যায় এক অপূর্ব ভ্রমণসুখে।
লাল ঝামেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ডায়না নদী, ভুটান পাহাড় ও চ্যাংমারি চা বাগান সবই বড় মুগ্ধ করে মনকে। পর্যটন সব সময় উচাটন মনে হয় না। একটু শান্ত, ধীরলয়ে ভ্রমণ আর বিশ্রামের দারুণ এক মিশেল হল লাল ঝামেলা বস্তি। এখানে আসুন, বসুন, দুটো দিন থাকুন লাল ঝামেলায়, কোনও ঝামেলা নেই। শুধুই অনাবিল আনন্দ।
সুব্রত সরকার
0 Comments