যমুনােত্রী ভারতের একটি অন্যতম তীর্থ ধাম।
দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার কন্যা সংজ্ঞা সঙ্গে সূর্যের বিয়ে হল। সূর্যদেব তার প্রশস্ত, আয়ত, উজ্জ্বল চোখে চেয়ে দেখলেন তার নব পরিণীতা বধু সংজ্ঞাকে। সংজ্ঞাকে কিন্তু সহজ সুন্দরভাবে দৃষ্টি বিনিময় করতে পারলেন না, স্বামী-সূর্যের চোখের ওপর চোখ মেলে। সূর্যকে দেখে তার চোখ দুটি কেমন নিমিলীত হয়েছিল। মন ক্ষুগ্ন সূর্যদেব অভিশাপ দিলেন বধূকে — তােমার গর্ভে যে পুত্র সন্তান হবে সে পুত্র প্রজা সংযম যশ হবে। ভীতা, সদ্য পরিণীতা বধূ সংজ্ঞা আবার চেয়ে দেখলেন সূর্যকে – কিন্তু সে চাহনি ছিল না স্থির, ধীর, প্রসন্ন — সে দৃষ্টি ছিল চঞ্চল। সূর্যদেব খুশী হলেন না — অপ্রসন্ন চিত্তে বললেন – এবার তােমার গর্ভে যে কন্যা সন্তান আসবে সে হবে চঞ্চলা, অস্থিরা, নদীরূপ ধারণ করবে। কালক্রমে সংজ্ঞার এক পুত্র ও এক কন্যা হল। পুত্রের নাম হল প্রজা সংযম যম আর কন্যার নাম হল যমুনা।
ত্রিলােকখ্যাতা যমুনা-যমরাজ ভ্রাতা-ভগিনী পুরাণ বর্ণিত। যমুনার অপর নাম কালিন্দী। বেদোক্তা নদী। যমুনা লােকপাবনীনদী। ভারতের সপ্ত পবিত্রনদীর অন্যতমা। রাধাকৃষ্ণের মধুর লীলাভূমি মথুরা, বৃন্দাবন – এই যমুনারই তীরে ভারত সম্রাট শাহজাহানের অমর প্রেমের কীর্তি সৌধ তাজমহল – এই যমুনারই তীরে আবার গঙ্গা যমুনার পুণ্যধন্য তীর্থ প্রয়াগ সঙ্গম এলাহাবাদ শহর — এই যমুনারই তীরে।
যমুনার উৎপত্তি স্থল হল – উত্তরপ্রদেশের উত্তরাখন্ডে গাড়ােয়াল হিমালয়ের রজত শুভ্র পর্বত, বন্দর পুচ্ছের চম্পাসার হিমবাহ হতে। সমুদ্র সমতা থেকে বন্দরপুচ্ছের উচ্চতা ২০,৭২০ ফুট। তুষারধবল পর্বতের হিমবাহের অংশ গলে গলে সৃষ্ট যমুনা তার নীল জলধারা নিয়ে দু’টি পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে নেমে এসে উপল বিছানাে অসমতল জঙ্গলাকীর্ণ সংকীর্ণ স্থানের উপর দিয়ে নিচে নেমে বয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে। তারপর প্রান্তরের পর প্রান্তর অতিক্রম। প্রবাহ ধারা ৮৬০ মাইল দৈর্ঘে। প্রথমে প্রায় ১০০ মাইল পার্বত্য প্রান্তর ধরে ছায়া সুনিবিড় পাইন, দেওদারের সবুজ বনের পা ধুয়ে ধুয়ে শিবালিক পর্বত অতিক্রম করে সাহারাণপুর জেলায় ফায়জাবাদের সমতল ভূমিতে যমুনা প্রবেশ করেছে। বন্দরপুচ্ছের হিমবাহ ধারা হতে আরও দুটি নদীর জন্ম হয়েছে হনুমান গঙ্গা ও তমসার। প্রবাদ, অতীতে মহামুণি অসিতের আশ্রমকুটির ছিল এই যমুনার তীরে। ঋষি প্রতিদিন গঙ্গা ও যমুনায় স্নান করতেন। একদিন ঋষি বৃদ্ধ ও অক্ষম হয়ে পড়লেন। চলবার শক্তি লােপ পেল। তিনি আর গঙ্গায় গিয়ে স্নান করতে পারতেন না। তাই গঙ্গার একটি প্রবাহধারা সরে এসেছিল ঋষির কুটির আশ্রমের কাছে। গঙ্গা ঋষির মনের কামনা পূরণ করেছিলেন এইভাবে।
যমুনার ধারা প্রবাহের পাশেই যমুনা দেবীর মন্দির। মন্দিরই এখানের প্রধান দর্শনীয়। যমুনার পূত পবিত্র জলস্পর্শে এ অঞ্চলের মাটি তীর্থে পরিণত হয়েছে। তাই যমুনােত্রী গাড়ােয়াল হিমালয়ের চার ধামের হয়েছে অন্যতম এক ধাম।।
যমুনার মন্দির ছােট আকারের — পাথর দিয়ে গড়া। পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে মন্দিরের দেওয়াল গড়া হয়েছে। প্রতি বছরই বরফপাতের ফলে মন্দির ভেঙেচুরে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই অন্য জায়গায় সরিয়ে আবার নতুন করে মন্দির গড়তে হয়। ওই রকম আগের তৈরি মন্দিরের ভগ্ন অবশেষ এখানে এলেই চোখে পড়ে। মন্দিরের স্থাপত্য শিল্প — অলংকরণ, কারুকার্য, শিল্প চাতুর্য - কিছুই নেই। খুবই সাদামাটা মন্দির। মন্দিরের মধ্যে গঙ্গা, যমুনার পাথরের মূর্তি বিরাজ করছে। অন্যান্য কিছু শিলামূর্তির মধ্যে শিব, গণেশের মূর্তি চোখে পড়ে। মন্দিরের নিচে তিনটি গরম জলের কুন্ড আছে। একটি কুন্ডের জল প্রচন্ড গরম — নাম তার সূর্য কুন্ড। এই জলে চাল, আলু পুঁটুলি বেঁধে ফেলে দিলে কিছুক্ষণ বাদে সিদ্ধ হয়ে ভাত হয়ে যায়। এই সিদ্ধ অন্ন প্রসাদ রূপে গণ্য এখানে। দ্বিতীয় কুন্ডের জলের উত্তাপও বেশী। তৃতীয় কুন্ডের জলে বেশ স্নান করা চলে এবং স্নান করারও বিধি। সূর্যকুন্ডের পাশে। একখন্ড শিলা আছে – তাকে দিব্য শিলা বলা হয়। কুন্ডে স্নানের পর প্রথমে এই দিব্য শিলায় পুজো দিয়ে তবে মন্দিরে যমুনা গঙ্গার পুজো দিতে হয়। এ মন্দিরের এইই নিয়ম। মন্দিরের পূজক, পান্ডারা পুজো করিয়ে দেন। পুজোর যাবতীয় সামগ্রী, উপাচার মন্দির সংলগ্ন দোকানেই পাওয়া যায়। তবে দোকানের সংখ্যা ও উপকরণের প্রাচুর্য গঙ্গোত্রী বাজারের মতাে নয়। সে তুলনায় অনেক কম ও নিঃষ্প্রভ। পুর্ণার্থী ও তীর্থপ্রেমীর সংখ্যাও এখানে অনেক কম। এখানে মন্দির সংলগ্ন একটি পাথরের গুহায় আশ্রম তৈরি করে এক বাঙালি সাধক বারমাস বসবাস করেন। মাধব মহারাজ নামেই তিনি পরিচিত। তার আশ্রমে থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। মন্দিরের তলা দিয়ে প্রবল বেগে বয়ে যাচ্ছে যমুনার জলস্রোত। যমুনার ওপর কাঠের সেতু মন্দিরের সঙ্গে ওপারে পথের যােগাযােগ রক্ষা করছে। পুলের আশে পাশে আছে দোকান, ধর্মশালা, বন বিশ্রাম ভবন ও সদাব্রত আশ্রম। কালীকমলীর প্রাচীন ধর্মশালাও আছে এখানে। সেখানেও বেশ থাকা চলে।
গাড়ােয়াল হিমালয়ের প্রবেশ পথ হরিদ্বার থেকে যমুনােত্রী ২৫৫ কি.মি.। নিয়মিত বাস চলাচল করে যমুনােত্রীর পথে হনুমান চটি পর্যন্ত। হনুমান চটির দূরত্ব বাস পথে ২৪১ কি.মি.। হৃষীকেশ, নরেন্দ্রনগর, চম্বা, টিহরী হয়ে বাস ধরাসু আসে। সেখান থেকে বরকোট হয়ে সানা চটি (২৩৪ কি.মি.)। সানা চটিতে পর্যটক বিশ্রাম ভবন আছে। এছাড়াও পূর্ত বিভাগের ইন্সপেকশন বাংলাে আছে. রাতে বেশ থাকা চলে। প্রচুর দোকান, হােটেল আছে। খাওয়ার কোনও অসুবিধা নেই। সানা চটি থেকে হনুমান চটি মাত্র ৭ কি.মি.। বাস যাত্রার ইতি হয়েছে এখানে। যমুনােত্রীর পথের শােভা ভােলা যায় না। সবুজের বর্ণালীতে দুটি চোখ সবুজ হয়ে ওঠে। পাইন, দেওদারের ছায়া যেন মায়া জাল পেতেছে এখানে। হনুমান চটিতে রাতের আশ্রয় মেলে। খাবারও মেলে। এখান থেকে যমুনােত্রী ১৪ কি.মি. পায়ে পায়ে যেতে হয়। না হলে এখানে ঘােড়া, ডান্ডি, কান্ডি সবই যাবার মেলে। কুলিও মেলে। হনুমান গঙ্গা তার প্রবল স্রোত নিয়ে এখানে এসে মিশেছে যমুনায়। রূপের তুলনা নেই এ পথের। এরপর পাইন দেওদারের নিবিড় ছায়া মাড়িয়ে মাড়িয়ে ফুল চটি হয়ে জানকী চটি (২৪৯ কি.মি.)। এখানে আছে পর্যটক বিশ্রাম ভবন আর আছে পূর্ত বিভাগের ইন্সপেকশন বাং লাে ও বন বিশ্রাম ভবন। জানকী চটি থেকে চড়াই পথে ৬ কি. মি. পথ যমুনােত্রীর। একদিনেই হনুমান চটি থেকে যমুনােত্রীর মন্দির দর্শন করে ফিরে আসা যায়। নয়ত মন্দির দেখে জানকী চটিতে রাত কাটিয়ে পরের দিন হনুমান চটি জানকী চটিতে রাতের থাকার ও খাবার ব্যবস্থা ভালই পাওয়া যায়।
এখানে আসার সব থেকে সুন্দর সময় মে থেকে জুন মাস। আবার সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসেও আসা যায়। বর্ষা ধােয়া শরতের নীল আকাশ। মনে হবে যেন ময়ূর পাখা মেলে দিয়েছে আকাশে। রােদে সােনার উজ্জ্বলতা। মে-জুন মাসে চার ধামে যাত্রী সমাগম হয় খুব বেশী। ফলে ভিড়ের আধিক্য লেগেই থাকে। ভাল থাকবার জায়গারও অভাব হয়। তাই সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে গাড়ােয়ালের এই চারধাম পর্যটন করাই ভাল। মােটামুটি পথঘাট মুক্ত থাকে আবহাওয়া তাে সুন্দর। প্রকৃতির রূপ মন্দিরে হিমালয়ের রূপ বৈচিত্র এই সময় ফুটে ওঠে অপরূপের সবটুকু ঐশ্বর্য নিয়ে।
0 Comments