Ghagharburi Mother Temple in Burdwan district. You have to come from Asansol.
ঘাঘরবুড়ি মায়ের মন্দির বর্ধমান জেলায়। আসানসোল থেকে আসতে হয়। ‘ঘাঘরা পরে মা দেখা দিয়েছিলেন বলে নাম ঘাঘরাবুড়ি। লােকের মুখে মুখে তা হয়েছে ঘাঘরবুড়ি। বহু বহু বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা ভিক্ষে করে খেতেন, একদিন কাঙ্গাল চক্রবর্তী নামে আমাদের এক পূর্বপুরুষ দারিদ্রপীড়িত হয়ে আত্মহত্যার সংকল্প নিয়ে নুনিয়া নদীর তীরে এই বটগাছটার তলায় এসে বসেছিলেন। হঠাৎ ঘাঘরা পরা এক জ্যোর্তিময়ী বৃদ্ধা তাঁকে দর্শন দিয়ে আত্মহনন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিলেন— সামনের নদীতে তিনটে শিলাখণ্ড পড়ে আছে। ওদের তুই তুলে এনে পূজো কর, মঙ্গল হবে। নদীতে নেমে কাঙ্গাল দেখলেন, সত্যিই তিনটে শিলাখণ্ড পড়ে। ভক্তিভরে তুলে এনে তিনি বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করলেন ‘পুজো তাে করবাে, কিন্তু কি রূপে?’তখন বৃদ্ধা শ্রী শ্রী চন্ডীর মন্ত্র উচ্চারণ করে তাকে চন্ডীরূপে পুজো করার নির্দেশ দিয়ে অকস্মাৎ অন্তর্হিত হলেন। সেই থেকেই ওই বটগাছের নীচে শিলাখণ্ডগুলিকে পূজো করা হয়। বাঁদিকে আছেন মহাদেব, মাঝখানে চণ্ডী, পাশে দুর্গা। তারপর থেকেই বংশ পরম্মপরায় এদের পুজো হয়ে আসছে। আর বলতে নেই, মা ঘাঘরবুড়ির কৃপায় আজ আমাদের অবস্থাও বেশ ভাল। এই কাহিনী আমি শুনেছি আমার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। তাদের কাছ থেকেই আমি জেনেছি যে কাঙ্গাল চক্রবর্তী শিলাখণ্ডগুলির পুজো শুরু করলেও জাগ্রত এই দেবীথানটি কিন্তু দুশাে বছরেরও বেশি পুরনাে। আসানসােলের প্রাচীন উপজাতিরা তখন ওই বটবৃক্ষকেই দেবীজ্ঞানে পুজো করতাে। গ্রামের জনৈক অদ্বিত নারায়ণ চক্রবর্তী নিয়মিত মাতৃপূজার ব্যবস্থা করেন। কিছুকাল চলার পর নানান অসুবিধের কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। কাঙ্গাল চক্রবর্তী ছিলেন অদ্বিত নারায়ণেরই প্রপৌত্র। তার পরবর্তী বংশধর অতুল চক্রবর্তী ও বিজয় চক্রবর্তীও নিয়ম করে মায়ের পূজাৰ্চ্চনা চালিয়ে যান। তাদের কাছ থেকেই তাে আমার সব পূজাপদ্ধতি শেখা। একটানা কথাগুলাে বলে স্মিত হাসলেন বর্তমানে মন্দিরের ভারপ্রাপ্ত পূজারী শ্ৰীদুলাল চক্রবর্তী। | যাক, এবার খােদ পুরােহিত মশাইয়ের মুখ থেকেই শুনলাম এই দেবীতীর্থের আসল কাহিনিটা। কেউ বলে, একবার ভােলানাথ শঙ্কর, মা কালী ও মা অন্নপূর্ণাকে নিয়ে নৃত্য করার সময় মাটের ঘাঘরা এখানে পড়েছিল। সেই থেকে তীর্থপীঠের নাম হয় ‘ঘাঘরাবুড়ি। লােকের মুখে মুখে হয় ‘ঘাঘরবুড়ি’। ১৮৫৭ সাল থেকেই এখানে মায়ের পুজো হয়ে আসছে। তখন নুনিয়ার তীরে এই মন্দিরে পুজো করতাে মাঝিরা। কিন্তু তারা ঠিক নিয়ম মেনে পুজো করে উঠতে পারছিল না। মায়েরও মন ভরছিল না। একদিন মা স্থানীয় এক জমিদারকে স্বপ্ন দিয়ে বললেন, তুই আমার মন্দিরে ব্রাহ্মণ দিয়ে পূর্জাচ্চনার ব্যবস্থা কর। তাের মঙ্গল হবে। তড়িঘড়ি জমিদারবাবু খবর পাঠিয়ে ডামরা গ্রাম থেকে এক পণ্ডিতকে নিয়ে এসে মন্দিরের পুরােহিত নিয়ােগ করলেন। তখন এই জায়গাটা ছিল ভীষণ দুর্গম। আসা যাওয়ার রাস্তাও ছিল না। পানীয় জলও ছিল না। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই সেই পুরােহিত বন্ধ করে দিলেন মন্দিরে আসা। আবার খোঁজ পড়ে গেল পুরােহিতের। অবশেষে সেই জমিদার নিজের পরিচিত ‘চক্রবর্তী’দের হাতে মায়ের পুজোর সমস্ত ভার সঁপে দিলেন। ভারতবর্ষের প্রায় সব তীর্থক্ষেত্র ঘিরেই আছে কত কত বর্ণময় বিচিত্র সব কাহিনি। সেই ছেলেবেলা থেকেই আমার ঘাঘরবুড়ি মন্দিরে যাওয়া আসা। আসানসােল বাইপাস তখনও তৈরি হয়নি। অণ্ডাল থেকে বাসে চড়ে আমরা নেমে পড়তাম আসানসােল ঢােকার ঠিক আগেই। তারপর জিটি রােড থেকে বেশ খানিকটা উত্তরে হেঁটে পৌছতাম মন্দিরে। মন্দির বলতে ঠিক যা বােঝায় তখন কিন্তু তা ছিল না। মায়ের নাকি আদেশ ছিল তিনি কোনও মন্দিরে থাকবেন না। মাথার উপর ছাদ তার মােটেই পছন্দ নয়। জনশ্রুতি, একবার এক ভক্ত নিজের মনস্কামনা পূরণ হওয়ায় মন্দির গড়তে গিয়ে নাকি ঘাের বিপদে পড়েন। সেই আমলে দেখতাম বটগাছের নীচে সিঁদুরচব্রিত শিলাবিগ্রহগুলিকে পুজো করা হত রােদবৃষ্টি মাথায় নিয়ে। গাছটিকে ঘিরে একটি চাতাল গড়ে দিয়েছিলেন আসানসােলের এক স্থপতি। মন্দিরের পাশ দিয়ে ভীষণ গর্জনে বয়ে যেত নুনিয়া নদী। চাতালে বসে সেই আওয়াজে কান পাতাই ছিল দায়। উদ্দাম নদী ভীষণবেগে লাফিয়ে পড়ত পাথরে উপর। সাদা ফেনা ভেসে ভেসে বেড়াতাে নদীর স্রোতে। ফুল মালা আর পুজোর উপাচার নিয়ে বসতাে একটা দোকান। আর ছিল একটা তেলেভাজার দোকান। ধারে পাশে তখন আর কিছুই ছিল না। পুরুতমশাই ভােরবেলা এসে পুজো শেষ করে দুপুরের মধ্যে ফিরে যেতেন। দোকানিরাও পাততাড়ি গােটাতাে। বাকিসময়টা দেবী এখানে একাই বিরাজ করতেন। দুপুরের পর পথ ভুলে এখানে কেউ এসে পড়লে নানান অলৌকিক কাণ্ডকারখানা দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে যেত। অনেকের নাকি জীবন সংশয়ও দেখা দিয়েছিল। এই মন্দিরকে ঘিরে সেই ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছি কতাে না অলৌকিক কাহিনি। সব তাে মনে নেই। শুধু মনে আছে কাশীপুর বাজার কাহিনিটি।
একবার কাশীপুরের এক রাজারানি মায়ের মন্দিরে এসে মানত করলেন। যদি ছেলে হয়, তাহলে মায়ের মন্দিরে পুজো দেবেন। মায়ের আশীর্বাদে তাদের ছেলে হল। রাজা রানি কিন্তু ভুলে গেলেন মায়ের পূজো দেওয়ার কথাটা। ছেলের অন্নপ্রাশন হল, শিশু থেকে বালক হল, সাবালক হয়ে বিবাহযােগ্য হল তবু রাজদম্পতীর মনেও পড়ল না তাদের মানতের কথা, এক সময় সেই ছেলের বিয়ে ঠিক হল। বিয়ের দিন নামলাে তুমুল বৃষ্টি, সঙ্গে প্রবল ঝড়। মন্দিরের সামনে এসে বরযাত্রী দাঁড়িয়ে পড়ল, কিছুতেই আর এগােতে পারছে না। নুনিয়া এখন ফুলে ফেঁপে ভয়ঙ্করী। ওদিকে বিয়ের লগ্ন বয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে রাজা দেবীর কাছে আবার প্রার্থনা করলেন, ঝড় জল বন্ধ হয়ে যদি ঠিক সময়ে সবাই মেয়ের বাড়ি পৌঁছতে পারেন তবে ফিরে এসে নিশ্চয়ই মায়ের পুজো দেবেন। মুহূর্তে থেমে গেল সেই ভয়ঙ্কর ঝড়ঝঞা। ঝড়ের বেগে আর বৃষ্টির তােড়ে হাতি, ঘােড়া সহ বরযাত্রী তলিয়ে গেল নুনিয়ার জলে। আশপাশের গ্রামবাসীরা আতঙ্কিত হল। তাদের স্বপ্নে ঘাঘরবুড়ি মা জানালেন, ‘ওই রাজা আমাকে পূজো দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পালন করেনি। তাই তাঁরা শাস্তি পেয়েছে।নুনিয়ার তীরের পাথরে নাকি হাতি, ঘােড়ার ছাপ আজও দেখা যায়। | এখন মন্দিরে ঢােকার পথে বিশাল তােরণ গড়া হয়েছে। আর প্রাচীন সেই বটবৃক্ষকে ঘিরে বানানাে হয়েছে মন্দির। বিগ্রহসহ পূজারীর বসার জায়গা রেলিং দিয়ে পৃথক করা। ভক্তরা বসেন রেলিংয়ের এধারে, অবশ্য বিশেষ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ওধারেও বসতে পারেন। ভক্তরা মার্বেলের চাতালে বসে সুষ্ঠুভাবে পুজো দেখেন ও অঞ্জলি দেন। নাম, গােত্র লিখে পুজোর ডালি জমা দিতে হয়। পুজো শেষে হাতে হাতে তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এখন দেবীমূর্তিদের ঘিরে গড়া হয়েছে সুদৃশ্য রূপাের সিংহাসন। তার মাথায় পরস্পর উল্টো দিকে মুখ করা ময়ুরের নক্সা। প্রতি শনিবার ধর্মচক্র সেবাসমিতি মায়ের খিচুড়িভােগের আয়ােজন করে। যে কোনও ভক্ত ওই ভােগের জন্য অর্থ দান করতে পারেন। ২১ টাকা থেকে ১০১ টাকা পর্যন্ত। মন্দিরকে ঘিরে এখন মেলার মতাে বসে গেছে দোকান। আসানসোেল বাইপাস তৈরি হওয়ায় এখন গাড়ি চড়ে সােজা আসা যায় মন্দিরে। তাই গােটা এলাকাটাই গাড়িতে গাড়িতে ছয়লাপ। নুনিয়ার সেই গতিও আর আজ নেই। মােটের ওপর সেই ভাবগম্ভীর পরিবেশটাই আর আজ নেই।
‘শুনেছিলাম মা কোনও মন্দিরে থাকবেন না। মাথার ওপর ছাদ মায়ের পছন্দ নয়। তবে আজ এমন মন্দির কেন? মায়ের কি তাহলে মত বদল হল? জিজ্ঞেস না করে পারলাম না দুলালবাবুকে।। | ‘দেখুন মন্দির তৈরি হলেও মা কিন্তু আছেন গাছের তলায়, খােলা আকাশের নীচে। মাথার ওপরটা ফাঁকা। আসলে কি জানেন, রােদবৃষ্টি থেকে বাঁচতেই ভক্তরা এটুকু গড়েছেন। দুলালবাবুর সহাস্য উত্তর।
কথাটা মিথ্যে নয়। শিলাবিগ্রহের ঠিক ওপরে সত্যিই কোনও ছাদ গড়া হয়নি। প্রাচীন সেই বটবৃক্ষটি শিলাখণ্ডগুলির মাথায় স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে। শনি, মঙ্গলবার এখানে ভিড় হয়। পয়লা মাঘের বার্ষিক উৎসবে তিনি দিন বিরাট মেলা বসে। হাজার হাজার মানুষ আসে জাগ্রত এই দেবীর থানে। জৈষ্ঠ্য মাসের অমাবস্যা তিথিতেও ধর্মচক্রসেবা সমিতির উদ্যোগে মেলা হয়। ওইদিন প্রত্যেক ভক্তকে খিচুড়ি ভােগ খাওয়ানাে হয়।
পুজো শুরু হয়ে গেছে। আভরণহীন শিলাখন্ডগুলিকে রূপাের ব্রিণয়ন, জিহ্বা, নাকে নথ পরিয়ে ফুল, মালা দিয়ে সাজিয়ে তুলেছেন দুলালবাবু। ধুপ, ধুনাে জ্বেলে নৈবেদ্য সাজিয়ে শুরু করেছেন পুজো। চলবে দুপুর পর্যন্ত। বিকেলের পরে কিন্তু এখনও | কেউ থাকে না মন্দিরে। আগের মতােই রাত্রে মা একাই বিরাজ করেন জাগ্রত এই তীর্থক্ষেত্রে।
ডাঃ অর্পণ রায় চৌধুরী
0 Comments