সপ্তাহান্তে ভ্রমণের পরিকল্পনায় এবার বাঘ-বনের দেউল।
বড়দার অনুপস্থিতিতে আমরা কিছুতেই স্থির করে উঠতে পারছিলাম না আমাদের গন্তব্য। অবশেষে বড়দাকে পাওয়া গেল এক শনিবারের বিকেলে। চায়ের আড্ডায় দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ইতিহাস নিয়ে শুরু হল জোর আলােচনা। আজ আমাদের আলােচনার বিষয়বস্তু হল জটার দেউল, যার ইতিহাস এখনও অন্ধকারে। তবে ঐতিহাসিকদের ধারণা এই স্থাপত্যটি বাংলার বুকে সবচেয়ে প্রাচীন নির্মীয়মান মন্দির। ইংরেজ আমলে সুন্দরবনের মণি নদীর তীরবর্তী গভীর অরণ্য আচ্ছাদিত এই অঞ্চলের লট নম্বর নির্ধারিত হয়েছিল ১১৬। দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরী এবং দিগম্বর মিত্র এই লট নম্বরের ভূস্বামী হন। তাদের তত্ত্বাবধানে আনুমানিক ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে এখানকার বনভূমি পরিষ্কার করে আবাদি পত্তন শুরু হয়। সে সময় ময়ূরভঞ্জ থেকে আগত ২০ জন মুন্ডা এই বনভূমি হাসিল করার দায়িত্ব পান। কিন্তু সেখানে প্রচুর বাঘ থাকায় এই কাজে বাধা পড়ছিল। ফিলিন্স নাথ নামক এক যুবক বাঘ শিকারে নিয়ােজিত হন। বাঘ শিকারে সে সময় তার খুব নাম ডাক ছিল। পনেরােটিরও বেশি বাঘ শিকার করে শেষ পর্যন্ত এই অঞ্চলের বনভূমি হাসিল হয়।ফিলিন্স নাথের কৃতিত্বে তার পদবী পরিবর্তিত হয়ে নাম হয় ফিলিন্স শিকারী। ওদিকে বন হাসিল করতে করতে বনভূমির মধ্য থেকে আত্মপ্রকাশ করে অপূর্ব সুন্দর রেখশৈলীর দেউলটি। স্থানীয় অধিবাসীরা আজও মনে করে যে জটাযুক্ত একটি নরখাদক বাঘ এই পরিত্যক্ত মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিল এবং সেই কারণেই এই মন্দিরটি জটার দেউল নামে পরিচিত। জটার দেউলের নামকরণ নিয়ে আর একটি ধারণা এই অঞ্চলে প্রচলিত আছে। মন্দিরের আরাধ্য দেবতা ছিলেন জটাধারী শিব, তাই তার নামানুসারেই হয়েছে মন্দিরের নামকরণ।
বাবলুর কথায় রাজি হয়ে বড়দা শুরু করল জটার ইতিহাস। ফিলিন্স শিকারীর তত্ত্বাবধানে বাঘ শিকার পর্ব শেষ হলে শুরু হল অরণ্য সংস্কার। বনভূমি পরিষ্কার করার পুরস্কার স্বরূপ ২০ জন মুন্ডাকে জমিদারের পক্ষ থেকে ২৫ বিঘা জমি উপহার দেওয়া হয়েছিল। মুন্ডাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাখাল মুদি। তার প্রত্যক্ষদর্শী বংশধরদের জবানীতে জানা যায়, সে সময় জনৈক স্মিথ সাহেব মন্দিরের মধ্যে বেশ কিছু অলঙ্কার, কষ্টি পাথরের মূর্তি লুণ্ঠন করেন। মন্দিরের মাথায় যে সােনার কলস ছিল, সেটা হস্তগত করার উদ্দেশ্যে কামান দেগে মন্দিরের চূড়া ধুলিসাৎ করেন। কথিত আছে, সােনার কলসের সােনা ঠিখরে গিয়ে মণি নদীর ওপারে যে স্থানে পড়েছিল সেই স্থানের নাম হয় সােনাটিকারি। এখনও এই গ্রামটি বিদ্যমান। প্রত্যক্ষদর্শীদের থেকে জানা যায়, এই মন্দিরের সামনে একটি আধভাঙা আটচালা ছিল। আটচালার দেওয়ার ভেঙে গেলে হেতালের খুঁটি পুঁতে খড়ের চাল করে দেওয়া হয়েছিল। আটচালার সামনে একটি কুয়াে ছিল, যার জল শিবের মাথায় ঢালা হত। কালিদাস দত্ত বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির মনােগ্রাফে এটির ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এই মন্দিরের অনতিদূরে উত্তরপার্শস্থ ভূমি থেকে ১৮৭৫ খিষ্টাব্দে একটি তামার প্লেট পাওয়া গিয়েছিল। প্লেটটি পেয়েছিলেন জমিদার দুগাপ্রসাদ চৌধুরী। ডায়মন্ডহারবারের তৎকালীন ডেপুটি কালেক্টার এই তথ্য জানিয়েছিলেন। ওই প্লেট থেকে জানা যায় যে ৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে অর্থাৎ ৮৯৭ শকাব্দে জনৈক রাজা এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, ৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে এই অঞ্চলে চন্দ্র রাজাদের রাজকীয় ক্রিয়াকলাপ প্রতিষ্ঠিত ছিল। বঙ্গ ও সমতট রাজ শ্রীচন্দ্র তাঁর পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনে শ্রীহট্ট মন্ডলে বৌদ্ধ মঠের জন্য বহু ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করেছিলেন, সেখানে মণি নদীর কথা উল্লিখিত হয়েছে। জটার দেউলের সন্নিহিত অঞ্চলও মণি নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। এই চন্দ্র রাজারা এই অঞ্চলে অবস্থান করতেন কিনা তা গবেষণার বিষয়। তবে উৎখননের সময় দেখা গেছে, বর্তামন জটার দেউল একটি অতি প্রাচীন ভিত্তির উপর স্থাপিত এবং এই মন্দির নির্মিত হওয়ার আগে একটি প্রাচীনতর স্থাপত্য বিরাজ করার সমূহ সম্ভাবনা। এই অঞ্চল থেকে কৃষাণ মুদ্রা পাওয়া যায়, যার একদিকে ষাঁড়ের পিঠে শিব বসে আছেন, আর অন্যদিকে বিজাতীয় পােশাকে দ্বিতীয় কদফিস দাঁড়িয়ে। জটার দেউলের দক্ষিণপূর্ব দিকে ছাটুয়া নদীর পূর্বপাড়ে বড় বড় ইটের স্তুপ থেকে নানান জিনিসের সাথে বেশ কিছু তামার মুদ্রা, দিগম্বর জৈন তীর্থঙ্করের কালােপাথরের মূর্তি, কনিষ্ক ও স্কন্দগুপ্তের স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায়। এরপর আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার পক্ষে ড. টিড ব্লক ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে দেউলটিতে এবং তার সংলগ্ন অঞ্চলে অনুসন্ধান কার্য চালান। তারপর ওই সংস্থার ইস্টার্ন সার্কেলের অ্যাসিস্টেন্ট সুপারিন্টেনডেন্ট জে. এফ. ব্ল্যাকিস্টোন ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বর দেউলটিতে পুনরায় পরিদর্শন ও অনুসন্ধান কার্য চালান এবং ভারতীয় সর্বেক্ষণের কাছে এটিকে সংরক্ষিত স্মৃতিসৌধ রূপে অধিগ্রহণ করার জন্য সুপারিশ করেন। এরপর ভারত সরকার মন্দিরটিকে অধিগ্রহণ করেন এবং ১৯৩০-৩১ খ্রিষ্টাব্দে সেখানে বড় ধরনের সংস্কার কার্য চালান। বিশেষজ্ঞের মতে এই সং স্কারকার্যে জটার দেউলের আদি সৌন্দর্য লুপ্ত হয় এবং পঞ্চরথ গাত্রদেহ ত্রিরথে পরিণত হয়। রেডি থাকিস, পরের স্টেসন জয়নগর, তারপরই মথুরাপুর। বড়দায় কথায় আমাদের খেয়াল হল। চটপট মালপত্তর নামিয়ে আমরা তৈরি হয়ে নিলাম। স্টেশনে নেমেই একটা অটো পেয়ে গেলাম। সবুজ গ্রাম বাংলার বুক চিরে ছুটে চলেছি বাদাবনের সাম্রাজ্যে। দেউলের ভিতর থেকে
মস্ত মূর্তি এবং অলঙ্কার মন্দির আবিষ্কারের সময় হস্তান্তর হলেও মন্দির অভ্যন্তরে প্রােথিত একটি শিবলিঙ্গ তখনই স্থানান্তরিত হয়নি। বহু বছর ধরে সেই শিবলিঙ্গ পূজিত হত। ক্ষেত্রসমীক্ষায় জানা যায়, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বাচস্পতি পদবীধারী জনৈক ধনী এবং নামজাদা ব্যক্তি বহু বছর আগে সেটিকে সংগ্রহ করে দক্ষিণ বিষ্ণুপুরে তাদের বসতবাটির কাছে প্রতিষ্ঠা করেন। বিষ্ণুপুর শ্মশানের পশ্চিমদিকে পাকা রাস্তার পাশে এই অপূর্ব সুন্দর শিবলিঙ্গটি এখনও প্রােথিত আছে। এই লিঙ্গটি অবস্যই তান্ত্রিক ঘরানার এবং পরিত্যক্ত হওয়ার পূর্বে জটার দেউলে তন্ত্র ঘরানার লিঙ্গ পূজিত হত। প্রায় এক ঘণ্টার সফর শেষে পৌছলাম রায়দিঘি। সেখান থেকে মােটরভ্যানে চেপে রওনা দিলাম কঙ্কনদিঘির পথে। মণি নদী পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম সুন্দরবনের আরেক অংশে। যেখানে মাতলা নদীর কূলে দন্ডায়মান প্রাচীন জটার দেউল। প্রাচীন ঐতিহাসিকেরা মনে করেন বর্তমান সুন্দরবনের আদি নাম ছিল ‘গঙ্গারাষ্ট্র’ বা ‘গঙ্গারিডি’। মেগাস্থিনিসের বিবরণেও আমরা গঙ্গারিডির নাম জানতে পারি। এই গঙ্গারিডি রাজ্যের রাজধানী ছিল। ‘গঙ্গে বা গঙ্গেরেজিয়া এবং এই রাজ্য ছিল ভাগীরথীনদীর পূর্ব তীরে। তৎকালীন এই নগরী ছিল ভারতের এক শ্রেষ্ঠ সমুদ্র বন্দর। অনুমান করা হয় মহাতীর্থ সাগরদ্বীপের মাটির তলায় সেই প্রাচীন পুরাকীর্তি আজও ঢাকা পড়ে আছে কিংবা সমুদ্রের তলায় তার অধিকাংশই বিলীন হয়ে গিয়েছে। সুন্দরবনের নানা স্থানের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ও পুরাকীর্তি অতীতের গৌরবােজ্জ্বল কাহিনীর সন্ধান বহন করে চলেছে। ঠিক তেমনি জটার দেউল সুন্দরবনের প্রাচীন পুরাকীর্তির এক নিদর্শন। কীভাবে যাবেন : শিয়ালদার দক্ষিণ শাখা থেকে প্রতিদিনই রয়েছে লক্ষ্মীকান্তপুর বা নামখানা যাওয়ার ট্রেন। মথুরাপুর স্টেশনে নেমে অটোয় বা ট্রেকারে রায়দিঘি, তারপর সেখান থেকে মােটরভ্যানে সােজা জটার দেউল।
আনন্দ ব্যানার্জী
0 Comments