It is unimaginable to leave Cochin or Kochi on a trip to Kerala. You must respond to the call of the Queen of the Arabian Sea. Cochin is made up of the mainland Enakulam and several islands in the Arabian Sea.


কেরালা ভ্রমণে এসে কোচিন তথা কোচি-কে বাদ দেওয়া কল্পনাই করা যায় না। আরব সাগরের রানির ডাকে আপনাকে সাড়া দিতে হবেই। মূল ভূখণ্ড এনাকুলাম আর আরব সাগরের বুকে কয়েকটি দ্বীপ উপদ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে কোচিন। দুপুরে খাওয়ার পর আমাদের কোচিনের এক বন্ধু বললেন, ‘কোচিন পৃথিবীর অন্যতম সেরা প্রাকৃতিক বন্দর। এরনাকুলাম আর কোচিন যমজ শহর। এরনাকুলাম বেশ ব্যস্ত শহর রয়েছে রেলস্টেশন প্রধান বাস স্ট্যান্ড, প্রচুর হােটেল, বহুপ্রাচীন জাহাজঘাট আর বেশ ঘন বসতি। এরনাকুলামের উল্টোদিকে রয়েছে উপদ্বীপ ফোর্টকোচি আর উইলিংডন বােলগাট্টি, ভাইপিন দ্বীপ। ১৪৯৮ সালে ভাস্কো ডা-গামা এখানে আসায় বিশ্বের দরবারে কোচিন পরিচিত হয়ে যায়। আর এর ফলেই মশলা বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হিসাবে কোচিনের নাম জগৎ জেনে যায়। পায়ে পায়ে আমরা পৌঁছে গেছি ফোরশাের রােড ধরে সমুদ্রের ধারে। এখানেই ফাইন আর্টস জেটি। এখান থেকেই অনেক প্রাইভেট কোম্পানির জল পথে কোচিনভ্রমণের ট্যুরগুলির শুরু হয়। সামনেই কেরালা ফাইন আর্টস সােসাইটি হল। এখানে প্রতি সন্ধ্যায় কেরালার প্রসিদ্ধ লােকনৃত্য কথাকলির প্রদর্শনী হয়। কথাকলি বােধহয় এমনই এক নৃত্যশিল্প যেখানে সারাশরীরের অঙ্গভঙ্গি ও চোখের ইশারায় কথা বা গল্প বলা হয়। নৃত্যশিল্পীদের সাজপােষাক ও মুখের ‘মেক-আপ’ সত্যিই অনন্য। কথাকলি নাচে পৌরাণিক চরিত্রের অভিনয় করা হয়। কথাকলি নাচের বিভিন্ন মুদ্রা ও চাউনির ব্যাখ্যা দেওয়ার পর মহাভারতের একটি কাহিনীর নৃত্যরূপ দিলেন দুই কথাকলি শিল্পী। সমুদ্র বলে ভুল হয়েছিল তা আসলে ব্যাক ওয়াটার স্থানীয় নাম ভেম্বনদ লেক। এই ব্যাকওয়াটার তথা খাঁড়ি পথে মােটর লঞ্চ বিভিন্ন দ্বীপে সফর করবে। প্রথমেই দুর থেকে কোচিন শিপ ইয়ার্ড দর্শন। অনেক জাহাজ মেরামত, রং করা হচ্ছে এখানে। নানারকমের ক্রেন আর অন্যান্য যন্ত্রের সমাহার। কাছ থেকে হয়ত আরও খুঁটিয়ে দেখা যেত। এবার বাঁদিকে ইউলিংডন দ্বীপ। জানা গেল এই দ্বীপেই আছে কোচিনের একমাত্র বিমানবন্দর। জলপথ ছাড়াও স্থলপথেও এরনাকুলাম থেকে এই দ্বীপে যাওয়া যায়। গাইডের কথায় জানা গেল এই দ্বীপ কৃত্রিম দ্বীপ। ব্রিটিশরা ফোর্ট কোচি বন্দরের নব্যতা বাড়াবার জন্য যে ড্রেজিং (মাটিকাটা) করেছিল সেই মাটির সৃষ্টি এই দ্বীপ। লর্ড উইলিংডনের নামে এই দ্বীপের নামকরণ। বসতি গড়ে উঠেছে এই দ্বীপে। জলের ধারেই পাঁচ তারা হােটেল। হােটেলের ক্যাটামারান হােটেলের জেটি থেকে বিভিন্ন দ্বীপে যাতায়াত করে। এরপর ডানদিকে পড়ে বােলঘাট্টি দ্বীপ।

দেখে নিতে হবে ডাচ প্যালেস আর জুইস সিনাগগ। ফেরিঘাট থেকে ডাচপ্যালেস চার-পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ। যেতে যেতে অমাদের বন্ধু এই প্রাসাদের ইতিহাস সম্পর্কে একটু ইঙ্গিত দিয়ে দিলেন। ১৫৫৭ সালে এই প্রাসাদটি পর্তুগিজরা কোচিনের রাজা বীর ভমাকে উপহার দেন তাদের জলপথে বাণিজ্য করার অনুমতি দেওয়ার জন্য। কোচি তখন পর্তুগিজদের কলােনি। প্রায় ১০০ বছর পরে আবার হয় পালাবদল। ওলন্দাজরা পর্তুগিজদের হাটিয়ে এই অঞ্চেলের দখল নেয়। ১৬৬৩ সালে এই প্রাসাদটি আবার সংস্কার করে কোচির রাজাকে দান করে ওলন্দাজরা। তখন থেকেই প্রাসাদটির নামকরণ হয়ে যায় ডাচ প্যালেস। অন্ধকার সরু সিঁড়ি দিয়ে নিচের মিউজিয়ামেও যাওয়া যায়। এখানেও একই ধরনের পােষাক, অস্ত্র, ছবি, কাগজপত্র ইত্যাদি। এখানে একটাই অসুবিধা ফ্ল্যাসগান দিয়ে ছবি তােলা নিষিদ্ধ। বাইরে থেকে প্রাসাদের ছবি তুলেই সন্তুষ্ট থাকতে হল। প্রাসাদচত্বরে রয়েছে ভারতী, শিব আর বিষ্ণু মন্দির।

এবার আমরা যাব ইহুদি সিনাগাগের দিকে। পথ গিয়েছে মশলাপট্টির মধ্যে দিয়ে। কেরালার বিখ্যাত সব মশলা-লবঙ্গ, এলাচ, দারচিনি, গােলমরিচ এইসবের খুচরাে পাইকারি দোকান এইখানে। মশলাপট্টির পাশের গলি ‘জু’টাউন ইহুদিদের বসতি। আমাদের বন্ধু জানালেন এই বাড়িগুলি ও বসতি অতি প্রাচীন। বেশির ভাগ দোকানই কিউরিও শপ, তবে তিনি সাবধান করে দিলেন এখানে কিছু কিনলে ঠকার যথেষ্ট ভয় আছে।

আবার আমাদের স্থানীয় বন্ধুর স্মরণাপন্ন হতে হয় সিনাগগের বৃত্তান্ত জানার জন্য কারণ লােকল গাইডের উচ্চারণ বৈশিষ্টের জন্য বেশিরভাগ কথাই বােঝা দায়। জানলাম এই সিনাগগটি ১৫৬৮ সালে নির্মিত হয়। পরে ১৬৬২ সালে পর্তুগিজ আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ১৬৬৪ সালে ওলন্দাজরা এটি সংস্কার করে পুর্ণনির্মান করেন। আমরা ততক্ষনে সিনাগগের গেটে পৌঁছে গিয়েছি। বেশ ভীড় দর্শনার্থীর ঠেলাঠেলিও হচ্ছে। জুতাে খুলে টিকিট কেটে সিনাগগে প্রবেশ। এখানে অবশ্য ছবিতােলার কোনও বাধানিষেধ নেই। উপাসনাগৃহের ভেতর রঙীন ঝাড়বাতি, হিব্রু ভাষায় প্রাচীন লিপি, রঙবেরঙের চিনা টালির কারুকার্য দেখার মতাে। ঝাড়লণ্ঠনগুলাের কাচে আলাে পড়ে ঝকঝক করছে। মাঝখানে পেতলের রেলিং দিয়ে ঘেরা গােল জায়গায় পুরােহিতের প্রার্থনাস্থল আর ওপরের ব্যালকনিতে লাইন দিয়ে দাঁড়ায় ভক্তরা। এরমধ্যেই আমাদের সময়সীমা শেষ হয়ে গিয়েছে অতএব ছুট ছুট আবার লঞ্চে ফিরে আসা।

বােট আবার চলতে শুরু করেছে। একটু পরেই বােট থামল ফোর্ট কোচির জেটিতে। জলের ধারে পর পর চাইনিজ ফিসিং নেট তথা মাছধরার জাল। কেরালা উপকূল অঞ্চলে মাছ ধরার এই অভিনব উপায়টি ১৩ শতকে কুবলাই খানের আমলে চিনা জেলেরা

উপকূল অঞ্চল ছাড়া ভারতে এই পদ্ধতি আর কোথাও অনুসরণ করা হয় না। এই পদ্ধতিতে কাঠের খুঁটির ওপর বসান থাকে একটা বড় তিনকোনা কাঠের ফ্রেম আর ফ্রেমে লাগানাে থাকে মাছ ধরার জাল। পাথরের ভার দিয়ে এগুলিকে জলে নামানাে হয় তারপর আস্তে আস্তে তুলে নেওয়া হয় কপিকলের সাহায্যে। চিনা জালের পাশে সুন্দর বাঁধানাে পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম ডাচ সিমেট্রির কাছে। এখানেই ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন গির্জা সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চ। লঞ্চের গাইড মহাশয় দেখি কখন আমাদের সঙ্গে চলে এসেছে। তার সঙ্গে কথােপকথনের থেকে যা উদ্ধার করা গেল তা হল ১৫০৩ সালে পর্তুগিজরা এই চার্চটি নির্মাণ করেন। ১৫২৪ সালে এই চার্চেই সমাধি দেওয়া হয় বিখ্যাত পর্তুগিজ অভিযাত্রী ভাস্কো-ডা-গামাকে। ১৩ বছর পরে অবশ্য তার দেহাবশেষ পর্তুগালে স্থানান্তরিত হয়। গাইডমহাশয় এগিয়ে গেলেন, বাকি ইতিহাস শুনলাম আমাদের বন্ধুর মুখে। পর্তুগিজদের হাত থেকে এই চার্চের দখল ওলন্দাজদের হাতে চলে যায় ১৬৬৩ সালে। ১৭৭৯ সালে ডাচেরা এর ব্যাপক সংস্কার করার পরে ১৭৯৫ সালে এটি দখল করে ব্রিটিশরা। চার্চে প্রবেশ করে অন্যান্য গির্জার সঙ্গে এর তফাৎ অবশ্য বিশেষ নজরে এল। তবে টিন্টেড রঙিন কাচের ব্যবহার বেশ দর্শনীয়। চার্চে প্রার্থনা চলছিল শেষ হবার পর বাইরের ঘাসজমিতে বসে সঙ্গে আনা ফ্লাক্সের কফির সদ্বব্যবহার করা গেল। আবার বােটে ফিরে আসা। এবার আর কোথাও নয় ভেম্বনদ লেকের জল কেটে বােট ফিরে এল আটগ্যালারি জেটিতে। এখান থেকেই আমরা বিকাল সাড়ে পাঁচটায় যাব সান সেট ট্যুরে। বেলা বারটা বেজে গেছে। জলের ধার ধারে হাঁটি। আলাদা জেটি থেকে সাধারণ যাত্রী লঞ্চ ছাড়াছে। এখান থেকে যাওয়া যাবে দ্বীপ থেকে দ্বীপে। ফোর্ট কোচি, মাট্টানচেরি, বােলগাটি সব দ্বীপে যাওয়া যায়। দেখা হল মেরিন ড্রাইভ, সি লর্ড জেটি। জেটির পাশেই চিলড্রেন পার্ক। পাঁচ টাকা প্রবেশমূল্য। ভেতরে রয়েছে বাচ্চাদের খেলার উপকরণ, রেস্টুরেন্ট আর বােটিং-এর জন্য ছােট্ট জলাশয়। দুপুরে চিংরিমাছ, পমফ্রেট মাছ আর ফ্রায়েড রাইস দারুন জমে গেল। সঙ্গে কমলা আর আনারসের ঠাণ্ডা রস। মেরিন ড্রাইভের কাছে জিসিডিএ শপিং কমপ্লেক্স-এর দোকানগুলাে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। কোচিনের ধাতব আয়না, চন্দন কাঠের সামগ্রী, পেতলের ঘর সাজানাের উপকরণ, গয়না, সুগন্ধী মশলা ইত্যাদি বিশেষ ভাবে প্রসিদ্ধ। ঘুরতে ঘুরতে সকলেই বেশ ক্লান্ত। মাকের্টিংটা কাল সকালের জন্য তুলে রেখে আমরা আবার ফাইন আটর্স জেটির দিকে এগিয়ে চলি। দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল। | ঠিক সাড়ে পাঁচটায় সানসেট ক্রুইসের বােট ছাড়ল। একই পথে বােট এগিয়ে চলেছে প্রায় আধ ঘণ্টা টানা চলার পর আমরা সেই চাইনিজ ফিসিং নেটের কাছে পৌঁছে গিয়েছি। দূর দিগন্তে দেখা যাচ্ছে আরব সাগরের মােহনা। সূর্যদেব তখন ভেম্বনদ লেকের জলে স্নান শুর করে দিয়েছেন। হ্রদের জলের রঙ এখন যেন গলানাে সােনা। চিনা জালগুলি সূর্যের অস্তগামী রশ্মির আভায় এক অনির্বচনীয় রূপ ধারন করেছে। বােট ফেরার পথ ধরল। ফিরতে ফিরতে হ্রদের জলে আঁধার নামে। তখনই জ্বলে উঠল আলাে পূর্বে-পশ্চিমে।

পরদিন সকালে এরনাকুলামের দরবার হলের কাছে কোচি মিউজিয়াম দেখে সােজা মার্কেটিং। আজকেই কোচিকে বিদায় জানাতে হবে। আমাদের বন্ধু আজকেও আমাদের সঙ্গ দিয়েছেন। বললেন, আপনারা আরও একদিন থাকলে দেখে আসতে পারতেন অথিরাপল্লী জলপ্রপাত। অবশ্য কোচিন থেকে অনেকটা দূর প্রায় ৭৮ কিমি। সালেয়ার পর্বতে চালাকুড়ি নদী ৮০ ফুট নিচে ঝাঁপ দিয়েছে ঘন জঙ্গলের মধ্যে। ওখানে রাত্রিবাস করলে আরও ভাল লাগত। দুঃখ করার কিছু নেই যা দেখেছি পুরানাে জাহাজঘাটার ব্যস্ততা, দূরে সমুদ্রের হাতছানি, লেকের মাঝে ছােট ছােট দ্বীপ ছুঁয়ে মাকড়সার জালের মত খাঁড়িপথ, ফেরি লঞ্চের যাতায়াত, প্রাচীন গির্জা, ইহুদি বসতি, সিনাগগ, চাইনিজ নেটের মধ্যে দিয়ে সূর্যাস্ত, ডাচ প্যালেস এ সব দেখা কি যথেষ্ট নয় ?