I went to visit Ghatshila in Jharkhand. Ghatshila is a mine of natural beauty intertwined with the memory of the immortal storyteller Bibhutibhushan Bandyopadhyay.

ঘাটশিলা বেড়াতে গিয়েছিলাম ঝাড়খণ্ডে। অমর কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতি বিজড়িত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের খনি ঘাটশিলা। উঠেছিলাম মৌভান্ডারের কাছে একটা হােটেলে। পায়ে হেঁটেই দেখে নিলাম সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। আর তারপর অটো ভাড়া করে দেখেছি সুবর্ণরেখা নদীর উপর ব্রীজ। রাতমােহনা দহ, ফুলডুংরি পাহাড়, টিলায় ভরা হরিণডুংরি, ঘাটশিলার রাজবাড়ি। আর রাজবাড়ির পেছনে নদীর মধ্যে কাছিমদহ। বিকেলে দেখতে গেলাম ধলভূমগড়ের পরিত্যক্ত বিমানবন্দরের রানওয়ে যা রয়েছে জঙ্গলে ঢাকা একদিন কনডাক্টটেড ট্যুরে বাসে বেড়াতে গেলাম গালুডি, টাটানগর, রাখা মাইনস, আসানবনি ইত্যাদি অঞ্চল আরও একটা দিন হাতে আছে। হােটেলের পাশেই একটা ছােট চায়ের দোকান, বিকেলে চা খেতে খেতে আলাপ হল এক বাঙালি ভদ্রলােকের সঙ্গে। অনিমেষবাবু, কলকাতায় বাড়ি, কিন্তু ত্রিশ বছর আগে প্রথম ঘাটশিলায় এসে এই গ্রাম্য শহরের প্রেমে এমন মজে গেছেন যে দুতিন বছরে একবার করে অবশ্যই আসেন। আগে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আসতেন। ঘন ঘন আসার জন্য তারা বিরক্ত হয়ে আর আসতে চান না। অনিমেষবাবু এখন একাই আসেন প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে। অন্তত তিন-চার দিন তাে থাকেই।

সবে সূর্য ডুবেছে। আর ঠাণ্ডা যেন ঝপ করে নেমে পড়ে রােদ পালানাের সঙ্গে সঙ্গেই। কয়লার উনুন জ্বলছে পাশে। আর গ্লাসে গরম চা, আলাপের পরে গল্পও জমে উঠেছে। কথায় কথায় অনিমেষবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, বুরুডি লেক দেখেছেন ?

না দেখিনি। কত দূরে? কিভাবে যাব? ফুলডুংরির পেছনে জঙ্গলের মধ্যে। প্রায় সাত আট কিলােমিটার যেতে হবে। অটো যাওয়ার রাস্তা আছে। তাই নাকি? তাহলে তাে খুবই ভাল। গিন্নি আর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললাম, তাহলে কাল বিকেলে যাওয়া যাক। ওরাও রাজী হয়ে গেল। অনিমেষবাবু হেসে বললেন, আমিও যাব আপনাদের সঙ্গে। অটোর সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসে পড়ব। আপত্তি নেই তাে? আপত্তি থাকবে কেন? আপনি গেলে আমাদের খুব ভাল লাগবে।

আমার চেনা অটো আছে। কুড়ি পঁচিশ টাকা কম নেবে। আমি আগে অনেকবার দেখেছি। তবে গত দু বছর যাই নি। তারপর আবার হেসে ফেললেন।

খুব সুন্দর তাে তাই বার বার দেখতে ইচ্ছে করে।

পরদিন দুপুর আড়াইটে নাগাদ অটো করে বেরিয়ে পড়লাম। অটো চলল। বিভূতিভূষণের বাড়ি যাওয়ার অপুর পথের মােড় পার হয়ে রেলগেট রেললাইন অতিক্রম করে চলতে থাকল ফুলডুংরি পাহাড়ের দিকে। তারপর বােম্বে রােড অতিক্রম করে ফুলডুং রি ছাড়িয়ে জঙ্গলের রাস্তা ধরল।

অনিমেষবাবু গল্পবাজ মানুষ। অনবরত কথা বলে যাচ্ছেন।

আমি প্রথম যখন ঘাটশিলা আসি, তখন অটো ছিল না। রিক্সা বা গরুর গাড়িতে বুরুডি যেতে হত। অথবা কাঠ নিয়ে আসার লরীতে। অনেকে দল বেঁধে হেঁটেও যেত এখন ভাবাই যায় না।

একটু বাদে আবার বললেন, তখন কোনও হােটেলও ছিল না। রাস্তার পাশে অল্প কিছু দোকান। মৌভান্ডারে হাট বসত। মােরগের লড়াই হত ওখানে।

আমরা শুনে যাচ্ছি। আর উনি ওনার স্মৃতি চারণ করছেন। অটো ঢুকে গেছে জঙ্গলের রাস্তায়। দু’পাশে, শালগাছের জঙ্গল। মাঝখান দিয়ে পাথরের বােল্ডার ফেলা রাস্তা। একটা আদিবাসী গ্রাম পার হলাম বেশ কিছু মাটির ঘর। তবে সুন্দর রঙ করা দেওয়াল। দাওয়ায় বসে থাকা আদিবাসীদের কৌতুহলভরা দৃষ্টি। রাস্তায় ঘুরতে থাকা কয়েকটা মুরগী ছিটকে দূরে সরে গেল। অনিমেষবাবু বলে যাচ্ছেন।

আগে এই জঙ্গল অনেক গভীর ছিল। আদিবাসীরাও খুব সােজা সরল ছিল। একবার এক আদিবাসীর ঘরে মুরগীর ঝােল আর ভাত খেয়েছিলাম। তারা কিছুতেই পয়সা নিল না। তারপর একটু থেমে যেন হতাশার সাথেই বললেন, ওরাও অনেক বদলে গেছে। জঙ্গলও কমে গেছে। কাঠ কেটেই তাে সব শেষ করে দিল।

আমার গিন্নি চারপাশ দেখতে দেখতে হঠাৎ বলে উঠলেন, দেখ দেখ ওই পাহাড়টা হােটেল থেকে দেখতাম। এখন কত কাছে! অনিমেষবাবু যেন আবার সুযােগ পেয়ে গেলেন কথা বলার। এই পাহাড়টার নাম বনকাটি। এর পরে ধারাগিরি নামে একটা বড় পাহাড় আছে। সেখানে একটা ঝর্না আছে। ধারাগিরি ঝর্না। এইবার অটোচালক বলে উঠল।। ধারাগিরি কিন্তু অটোতে যাওয়া যাবে না। রাস্তা খুব খরাপ। অনিমেষবাবু হেসে ফেললেন।

না না যেতে হবে না, আমরা যাব না। আগে রাস্তা ছিল না। লােকে হেঁটে যেত। এখন রাস্তা আছে, কিন্তু খারাপ বলে অটো যাবে না।

আরও একটা আদিবাসীদের গ্রাম পার হলাম। গ্রামটা আরও ছােট। জঙ্গল এখানে আরেকটু ঘন। তবে গভীর জঙ্গল বলতে যা বােঝায় তা নয়। চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ। আর মাথার উপর নীল আকাশ। এখন তিনটে বাজে। ভালাে রােদ আছে। বনকাট্টি পাহাড় এখন খুব কাছে। ফুলডুংরির থেকে অনেক বড় এই পাহাড়, তবে খুব উঁচু নয়। বড়জোর দু হাজার ফুট।

পাঁচ দশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বুরুন্ডি লেকের কাছে। লেকের সামনের কিছুটা অংশে জঙ্গল নেই। ফাঁকা মাঠের মতাে। বেশ কিছু মানুষ পিকনিক করছে। দু'চারটে ম্যাটাডাের ভ্যান দাঁড়িয়ে। কোথাও এখনও রান্না হয়নি। কোথাও খাওয়া চলছে। আবার কোথাও মাইকের গান আর কিছু নেশাগ্রস্ত মানুষের উদ্দাম নাচ। এই সব দৃশ্য বাদ দিলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতি মনােরম। দূরে দূরে আরও অনেক পাহাড় দেখা যাচ্ছে। ঘাটশিলা শহর থেকে এদের দেখা যায় না

চলুন, ওপরে ওঠা যাক। আরও ভাল দেখা যাবে।

অনিমেষবাবুর কথায় পাথর ভেঙে একটু ওপরে উঠলাম। বিশাল লেক। টলটলে নীল জল। দূরে দূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছে। বেশ হাওয়া দিচ্ছে। শীতের হাওয়া। তবু রােদ ঝলমলে দিনে এই হাওয়া বেশ উপভােগ করা যাচ্ছে। দূরের একটা পাহাড়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে অনিমেষবাবু বললেন, ওই যে ধারাগিরি পাহাড়। ওই পাহাড়েরই ঝর্না। ওখান থেকেই জন্মেছে খরস্রোতা।

খরস্রোতা? সে আবার কী? একটা ছােট্ট নদী। ধলভূমগড় যাওয়ার সময় পার হয়েছেন। মনে পড়ছে? সুবর্ণরেখায় গিয়ে মিশেছে। এখন মনে পড়ল, খুবই সরু নদী। তবে পাথরে ভর্তি। অনিমেষবাবু এবার দেখালেন। ওই দিকের রাস্তা দিয়ে ধারাগিরি যেতে হয়। অনেকটা পথ, হেঁটে গিয়ে সন্ধ্যার আগে ফেরা যাবে না।

লেকের ধারে বসে জলের দিকে তাকিয়ে রইলাম। প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টি পাহাড় দিয়ে ঘেরা এই জলাশয়। টলটলে নীল জল। আমার গিন্নি আর পুত্র ফটো তুলতে ব্যস্ত। আমি এই পাহাড় জল গাছপালা দেখতে দেখতে অভিভূত হয়ে পড়েছি। অনিমেষবাবু বলতে শুরু করলেন, জানেন, সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুব প্রিয় ছিল এই লেক। উনি একা একা হেঁটেই চলে আসতেন এখানে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন লেকের ধারে।

এমন নির্জন প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রকৃতি প্রেমিক লেখককে মুগ্ধ করবেই। আমাদেরই করেছে। তবে এই পরিবেশ নষ্ট করে দিচ্ছে মাইকের হিন্দি গান। আর মাঠ নােংরা করার জন্য পিকনিক পার্টির লােকেদের রান্না করা খাওয়া দাওয়া তাে আছেই। সারা শীতকাল ধরে চলে। বছরের পর বছর। তবে বিভূতিভূষণে আমলে হয়ত ছিল না।

অনেকক্ষণ বসে ছিলাম লেকের ধারে। শেষে অটোর ড্রাইভারের চিৎকার কানে এল। এবার যেতে হবে। আমরা উঠে পড়লাম। এমন সুন্দর জায়গা ছেড়ে আসতে কার আর ভাল লাগে?