শ্রী রাম জন্মভূমি অযোধ্যা।
হাতে আর একটা দিন রয়েছে। স্থির হল লখনউ থেকে ১৩০ কিমি দূরে অযােধ্যা নগরী অন্তত এক পলকে একটু দেখে যাই। গাড়িতেই যাব, তবে অযােধ্যা যাত্রার আগে লখনউ-এর আর এক নতুন পর্যটন ক্ষেত্র বােধহয় না দেখে গেলেই নয়। আধুনিক লখনউ শহরকে সবুজ করার উদ্যোগে গড়ে উঠেছে শহরের আনাচে কানাচে ছােটবড় অনেকগুলি উদ্যান। তারই মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ‘ডঃ ভিমরাজ আম্বেদকর সামাজিক পরিবর্তন স্থান’। ১০৭ একর জুড়ে এইনবনির্মিত উদ্যানে শুধুমাত্র উদ্যান নয় রয়েছে স্থাপত্য, স্মারক, সংগ্রহশালা, গ্যালারি ইত্যাদি। এই বিশাল আয়ােজনে রয়েছে সবুজ উদ্যানের মধ্যে দিয়ে পথ কেটে চকচকে পাথরের রাস্তা। চারিদিক ঘিরে আম্বেদকর স্মারক, সামাজিক পরিবর্তন গ্যালারি, স্মারক প্রতিবিম্বস্থল, স্মারক দৃশ্যস্থল, ইত্যাদি বিভাগ। ছােট্ট লেকের মধ্যে ফোয়ারা, নানা ভঙ্গিমায় অসংখ্য হাতির মূর্তি উদ্যানটিকে যেন আরও অনন্যতা দিয়েছে। উদ্যানপর্ব মিটিয়ে গাড়ি ছুটল লখনউ শহর ছাড়িয়ে অযােধ্যার উদ্দেশে।
সরযু নদীর তীরে অযােধ্যা নগরী, রামচন্দ্রের পবিত্র জন্মভূমি। প্রথমেই পৌঁছে যাই সরযূ নদীর পবিত্র ঘাটে। এ যেন বারানসীর এক ক্ষুদ্র সংস্করণ। একের পর এক ঘাট আর তার অন্য ধারে ছােট-বড় মন্দির আর সাধুদের আখড়া। এই সব বৈষ্ণব সাধুর দল কপালে গােপীচন্দনের তিলক কেটে মুখে শুধু সীতারাম সীতারাম ধ্বনিতে বাতাস মুখরিত করছে।।
অযােধ্যা এক প্রাচীন হিন্দুতীর্থ। আধুনিক মতবাদ আর মানসিকতার বােধহয় স্থান নেই। এখানে, সবই চলছে লােকবিশ্বাসের ওপর। পুরান বলে সূর্যবংশ এবং ইক্ষাকু বংশের রাজারা ছিলেন অযােধ্যার অধিপতি। রামচন্দ্রের পদস্পর্শেই শুধু নয়, বাল্মীকি, বশিষ্ট বিশ্বামিত্র দুর্বাশা, পরশুরাম প্রভৃতি ঋষি মহাঋষিদের পদস্পর্শেও পবিত্র অযােধ্যার ধুলিকণা।
মুসলমান যুগে অযােধ্যা রাজ্যের রাজধানী ছিল প্রথমে ফৈজাবাদ পরে লখনউ। এখন অযােধ্যা ফৈজাবাদ জেলার একটি শহর। ফিরে আসি আবার ঘাটের কথায়। রামঘাট ছাড়াও রয়েছে তপ্তঘাট। রামচন্দ্র এখানে স্বর্গে গিয়েছিলেন বলে কথিত আছে তাই অনেকেই এখানে পিতৃতর্পন করে থাকেন। সরযূ নদীর ওপর দিয়ে বিশাল সেতু বােটেও নদী পারাপারের ব্যবস্থা রয়েছে। ঘাটের ধারে অনেক ছােট বড় মন্দিরের মাঝে নাগেশ্বর শিবমন্দির। অযােধ্যার মন্দিরের সংখ্যা অসংখ্য। শহরের ২কিমি পরিসরের মধ্যে রয়েছে কয়েক হাজার মন্দির। রয়েছে ৩৫টি শিব আর ৬৩টি বিষ্ণু মন্দির।
সরু সরু রাস্তা, রাস্তায় ভিড়ও কম নয়, গাড়ি নিয়ে ঘােরাঘুরি করা বেশ মুশকিল। পৌছে গেলাম অযােধ্যার হনুমান মন্দিরে (হনুমানগড়ি)। খুবই বর্ণময় এই মন্দির। মন্দিরের মধ্যে রাম-সীতা আর সর্বাঙ্গে সিঁদুর মাখানাে হনুমানের বিশাল মূর্তি। সামান্য দূরেই রামকচহরি’ নামক ছােট একটি মন্দির। রামসীতা ভরত ও অন্যান্য মূর্তি দিয়ে সাজানাে এই মন্দির সম্পর্কে কাহিনী বলে এখানেই ছিল রামচন্দ্রের কাছারি। অযােধ্যার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মন্দির বােধহয় কনকভবন অর্থাৎ সােনে কা ঘর। এক আধুনিক শিল্প সমৃদ্ধ মন্দির গড়ে উঠেছে রামের জন্মস্থানের কাছেই। রাম, সীতা, ভরত, শত্রুঘর জাঁকজমক পূর্ণ মূর্তি শােভা পাচ্ছে মন্দিরে। শ্বেতপাথরে বাঁধানাে মন্দির চত্বর অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
আরও অনেক মন্দির রয়েছে অযােধ্যায়। রয়েছে বাল্মীকি আশ্রম, সুমিত্রাভবন, স্বর্গদ্বার, কৈকেয়ী ভবন, জৈন মন্দির...। ২ কিমি দূরে বুদ্ধের স্মৃতিবিজরিত মণি পর্বত কুবের পর্বত, সুগ্রীব পর্বত। | অনেকটা সময় গেল বিতর্কিত রাম জন্মভূমিস্থল দর্শনে। পুলিশ ও মিলিটারীর সুরক্ষার ঘেরাটোপে ঘেরা স্থান বার বার তল্লাস, লাইনে থমকে দাঁড়ানাে এই সব পর্বেই সময় নষ্ট হয়।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ যে শ্রীরামের জন্মভিটেতে নবরূপে রামমন্দির নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে অযােধ্যারই এক ধারে তার মডেলটি প্রদর্শিত হয়েছে। আবার মন্দির নির্মাণের অনুমতি মিললে যে সব পাথরের পিলার ব্যবহৃত হবে তারও শিল্পমন্ডিত কারুকার্য চলছে আর এক স্থানে।
সন্ধ্যে হয়ে এসেছে—পুরী তরকারী আর লাড়ু খেয়ে এবার ফিরতে হবে লখনউ। তারপর কাল সকালেই কলকাতা ফেরার ট্রেন।
আশিস কুমার ঘােষ
0 Comments