The past history of Siliguri claims that the city has no historical banadiana. Created as a corridor to Darjeeling. This town is the foot hills of the hill town of Darjeeling.
শিলিগুড়ির অতীত ইতিহাস দাবি করছে এই শহরটির ঐতিহাসিক কোনও বনেদিয়ানা নেই। শৈলরানী দার্জিলিং যাওয়ার করিডাের হিসাবেই মূলত এই জনপদের সৃষ্টি। এই জনপদই শৈলশহর দার্জিলিঙের ফুট হিলস। আজ যা দশ লক্ষ মানুষের বেশি ঝলমলে শহর। কলকাতার পরেই এ রাজ্যে প্রতি উন্নয়নমুখী দ্বিতী শহর বলে এই শিলিগুড়ি দাবি করে। ইতিহাসের বিবর্ণ পাতা ওল্টালে দেখা যাবে হিমালয়ের তরাই অঞ্চলে এই শহরটি ছিল স্রেফ একটি বনবস্তি। নাম ছিল ‘শিলগাড়া’। শিল মানে ছােট ছােট পাথর! আর কলার কাঁদিকে উত্তরবাংলার প্রাচীনরা বলতেন গুড়ি’। অন্যদিকে পাহাড়ী উপজাতিরা সেই কলার গুচ্ছকে বলত ‘গাড়া’ সব মিলিয়ে সময়ের পবিবর্তনে সম্ভবত অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে ‘শিলগাড়া’ নামের অপভ্রংশ হয়ে আজকের এই আধুনিক শহরের নাম হয় শিলিগুড়ি’। যার অগ্রগতি শুরু হয়েছিল ১৮৩৪ সাল থেকে। ১৯৬২-র চীন-ভারত যুদ্ধের পর উত্তর পূর্ব সীমান্তে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসাবে এই শহর চিহ্নিত হয়। ভৌগােলিক অবস্থানগত দিক থেকে এখন এই শহরকে বলা হয় উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রাজ্যগুলির ‘গেটওয়ে। যে শহর বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানের মত আন্তর্জাতিক সীমান্ত এলাকায় অবস্থান করছে। পশ্চিম, উত্তর এবং উত্তরপূর্বাঞ্চলের মােট নয়টি রাজ্যের প্রবেশপথও হচ্ছে এই শিলিগুড়ি শহর। ভারতের হঠাৎ বেড়ে ওঠা এই শহরগুলির মধ্যে এটি এখন অন্যতম শহর। সবচেয়ে বড়কথা দেশ এবং আন্তর্জাতিক পর্যটন মানচিত্রে এই শহর শিলিগুড়ি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পর্যটকদের শৈলশহর দার্জিলিং, সিকিম এবং ভূটান ভ্রমণে যেতে হলে এই শহরের বুকচিরেই যেতে হবে।
এবার ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গ সেই শিলিগুড়িতে। শিলিগুড়িকে কেন্দ্র করেই এমন কিছু ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে যা স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আজও সমীহ আদায়ের দাবি রাখে। সেই পটভূমির স্মারক স্মৃতি স্থানগুলিকে তুলে ধরার দায়িত্ব নেবে কে? এ প্রশ্ন আজ শিলিগুড়ির জনমানসের মধ্যেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। প্রশ্ন উঠছে রাজ্যের পর্যটন দফতর আর কতদিন এ নিয়ে উদাসীন ভূমিকা পালন করবেন?
ফিরে দেখা যাক শিলিগুড়ির টাউন স্টেশনকে। শিলিগুড়ির প্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে এখনও ধুকছে এই স্টেশন। যে রেল স্টেশন এক সময় স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক বীর সেনানীর পদস্পর্শে ধন্য হয়েছিল। সেই তালিকায় কে নেই? নেতাজী সুভাষচন্দ্র, বাঘা যতীন, মহাত্মা গান্ধী, চিত্তরঞ্জন দাশ প্রমুখ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবারতাে এই স্টেশনে এক রাত কাটিয়েও গিয়েছেন। এই স্টেশনেই রবীন্দ্রনাথ মুঙ্গারামের ক্ষীরের সিঙ্গাড়ার আস্বাদ গ্রহণ করেছিলেন বড় তৃপ্তির সঙ্গে। উল্লেখ্য মহাবীরস্থানের মুঙ্গারামই হচ্ছেন ক্ষীরের সিঙ্গারার জনক। এই স্টেশন ছুঁয়েই ভগ্নী নিবেদিতা গিয়েছেন দার্জিলিঙে। আরও কত মনীষী এই স্টেশনটিতে পা রেখেছেন তার তালিকা এই স্বল্প পরিসরে দেওয়া সম্ভব নয়। আসুন, আপনাদের নিয়ে যাই শিলিগুড়ির
জ্বল প্রাঙ্গন এখানকার আনন্দময়ী কালীবাড়ি। না, আর পাঁচটা বাঙালীর সমষ্টি নিয়ে তথাকথিত গড়ে ওঠা কালীবাড়ি এটি নয়। এই আনন্দময়ী কালীবাড়ির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক আবেগতাড়িত পটভূমি। শিলিগুড়ি পত্তনের পর এই কালীবাড়িই এই শহরে প্রথম প্রতিষ্ঠিত কালীবাড়ি। সাংবাদিক বন্ধুবর মৃণালকান্তি চৌধুরির এই কালীবাড়ির ইতিবৃত্ত বলছে, ১৯১৫ সালে মৃন্ময়ী মূর্তিতে এই কালীবাড়ির পথচলা শুরু। টিনের তৈরি মন্দির। মহাবীরস্থান এলাকায় ডি আই ফান্ডের কুড়ি কাঠা জমির ওপর এই কালীবাড়ি গড়ে উঠেছে। জমিটি হস্তান্তরিত করেছিলেন শিলিগুড়ির তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হলাে সাহেব। সেই সময় এই মন্দিরের সঙ্গে ছিল একটি শরীর চর্চার আখড়া। এই আখড়াতেই স্বদেশী আন্দোলনের বিপ্লবীরা গােপনে লাঠি ও ছােরা খেলার অনুশীলন করতেন। এই বিপ্লবীদের মধ্যমণি ছিলেন জলপাইগুড়ির বিজয় হােড় এবং পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন খ্যাত মধুসূদন দত্ত। ভারতে ইংরেজ শাসনের অবসানের লক্ষ্যে এই কালীবাড়ির আড়ালে শক্তির আরাধনার পাশাপাশি এই গােপন আস্তানা গড়ে তােলা হয়েছিল।
১৯২৫ সাল। বাংলার ১৩৩১ সন। ভারত থেকে বৃটিশ উৎখাত করার লক্ষ্যে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বরিশালের দামাল ছেলে চারণকবি মুকুন্দ দাস তার গানের দল নিয়ে বাংলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছেন বিপ্লবী এই চারণকবি ও তার দলবলের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের উৎখাত করে দেশকে বিদেশী শাসন থেকে মুক্ত করা। তিনি যেখানেই যেতেন সেখানেই গ্রেফতার হতেন বা পুলিশ তাকে তাড়িয়ে বেড়াতাে। মুকুন্দ দাস ছিলেন মাতৃসাধক। বাড়িতে তার কালী মন্দির ছিল। সেই কালী মায়ের নাম ছিল আনন্দময়ী। ইংরেজের তাড়া খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে সেই ১৯২৫ সালেই এলেন উত্তরবঙ্গে। হাজির হলেন সেই কালীমন্দিরে।। বিপ্লবীদের শরীর চর্চার গােপন আখড়ায়। তিনি শিলিগুড়ি এসে লক্ষ্য করলেন এখানে প্রতিষ্ঠিত কালী মন্দির নেই। চারণ কবির ইচ্ছে এখানে প্রতিষ্ঠিত হােক স্থায়ী কালীমন্দির। সেই ইচ্ছে নিয়েই ডি আই ফান্ডের হাটখােলায় চারণ কবি সাত রাত ধরে পালা গান গাইলেন। বিপ্লবী মন্ত্রে প্রাণিত হলেন। দু'হাত ভরে মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য চারণ কবির হাতে তুলে দিলেন অর্থ। সংগৃহীত হল দু’শাে টাকা। চুক্তিবন্ধ একান্ন টাকা। এক টাকা রেখে সব অর্থ কালীমন্দির প্রতিষ্ঠাকল্পে তুলে দিলেন মন্দির পরিচালকবর্গদের হাতে। বললেন, আরও অর্থ সংগ্রহ করে এখানে মন্দির প্রতিষ্ঠা করুন। আমি আবার আসব। মুকুন্দ দাশের উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঐকান্তিক আগ্রহে সকলে পথে নেমে পড়লেন। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠিত হল মন্দির। ১৯২৬ সালে কাশীধাম থেকে ৫০১ টাকা দিয়ে নিয়ে আসা হল কষ্টি পাথরের কালীমূর্তী। খবর গেল চারণকবির কাছে। এলেন তিনি। নিজের হাতে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করলেন সেই মাতৃমূর্তিকে। নাম দিলেন ‘আনন্দময়ী। দিনটি ছিল ১৩৩২ সনের মাঘী সংক্রান্তি। গাইলেন সেই রাতেই দু’টি পালাগান— ‘মাতৃমুক্তি’ ও ‘বলিদান’। চারণকবি বিপ্লবী মুকুন্দদাস উদাত্ত কণ্ঠে জানিয়ে গেলেন এই আনন্দময়ী মা’র নাম একদিন এখান থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে। মুকুন্দ দাসের প্রতিষ্ঠিত এই কালী মন্দির নবকলেবরে আজ অনুপম ভাস্কর্যে, স্থাপত্যে নির্মিত হয়েছে। বাস্তুকার ভাস্কর বিশ্বাসের অক্লান্ত পরিশ্রমে এবং প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব সেনগুপ্তের অদম্য ইচ্ছায় এই নতুন মন্দিরের ইতিহাস রচিত হয়েছে। রয়েছে মন্দিরের প্রতিটি সদস্য ও সদস্যার ঐকান্তিক সহযােগীতা ও প্রসাস। শুধু পুজো আচ্চাই নয়, সমাজসেবা ও সমাজ সচেতন করার নানা কর্মকান্ডও এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে এই শহরে আবর্তিত হচ্ছে বছরের পর বছর। বলা যায়, বিপ্লবী চারণকবি মুকুন্দ দাসের এই আনন্দময়ী কালীবাড়ি তার ইতিহাসের গৌরব গাথায় দক্ষিণবঙ্গের দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের মতই উত্তরবঙ্গের দক্ষিণেশ্বরীর সমীহ আদায় করে নিয়েছে। প্রায় শতবর্ষের পথ চলা এই মন্দির খুবই জাগ্রত। মন্দিরে দুর্গাপুজো হয় মহাসমারােহে। বাসন্তী পূজাও এঁরা করে থাকেন। একটি সুলভ অতিথিশালাও আছে। ৩৯ শয্যা বিশিষ্ট এই অতিথি নিবাসে পর্যটকরা অনায়াসেই থাকতে পারেন।
চারণকবির দেশপ্রেম এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের চেতনা ও অনুপ্রেরণায় গড়ে ওঠা শিলিগুড়ির এই ঐতিহ্যমন্ডিত আনন্দময়ী কালীবাড়ি পর্যটন মানচিত্রে উপেক্ষিত। লক্ষ লক্ষ পর্যটকরা যে শহরের বুক চিরে শৈল সৌন্দর্য্যে স্নাত হতে যাতায়াত করছেন, তারা জানেন না যে সেই শহরেই স্বদেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল ঐতিহাসিক পীঠস্থান তাদের অজ্ঞাত ও অগােচরেই নির্মমভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মহল থেকেই প্রশ্ন উঠছে, দাবী উঠছে, স্বদেশপ্রেমের গৌরবগাঁথায় গ্রথিত এই আনন্দময়ী কালীবাড়ির ইতিহাস পর্যটকদের কাছে পৌছে দিতে পর্যটন মানচিত্রে সংযােজিত করা হােক। সরকারের পর্যটন দফতরকে যেমন এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে, তেমনি বেসরকারি পর্যটন সংস্থাগুলিকেও এ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। প্রচার করতে হবে হংকং মার্কেট নয়, শিলিগুড়ির দর্শনীয় এবং গৌরবােজ্জ্বল স্মারক হচ্ছে চারণকবি বিপ্লবী মুকুন্দ দাসের ‘আনন্দময়ী কালীবাড়ি।
বিপ্লব ঘােষাল
0 Comments