সলিল সিনহা

শিতলাখেত যেন কুমায়ুন পাহাড়ের একবিন্দু ঝলক। সমস্ত হিমালয়তাে সৌন্দর্যের শিল্পাগার। সর্বত্রই তার চমক, সর্বত্রই শিহরণ। সিমলা বা মানালি দেখে আমরা উচ্ছসিত হই। আবেগতাড়িত হয়ে বলি - শৈলরানি। আবার খাজিয়ার বা ভারমােরের মধ্যে খুঁজে পাই সুইজারল্যান্ডের ক্ষুদ্র-সংস্করণ। কিন্তু শিতলাখেতের উপমা? অনন্যা নয়, অন্যতমা নয়, শুধু একটি মাত্র শব্দ উচ্চারিত হতে পারে – অদ্বিতীয়া। আলমােড়া থেকে মাত্র ৩৫ কিমি দূরে এই শিতলাখেত। অথচ কি ব্যবধান। এখানে জনপুরীর কলকাকলি নেই, নেই মেকি আধুনিকতা। আছে একরাশ নীরবতা, আছে ছায়াঘেরা গভীর বনানী, উত্তরে তুষারমৌলি হিমালয়ের শুচীশুভ্র তরঙ্গমালা আর নাম না জানা পাখির কলতান। | ফিরছিলাম দ্বারাহাট থেকে। পথ এসে মিলিত হয়েছে রানিখেত-আলমােড়া রােডের ওপর অবস্থিত ‘উপতে। ডানদিকে মাত্র ৭ কিমি দূরে রানিখেত। বাঁহাতি পথ গেছে মাঝখালি, কাঠপুরিয়া হয়ে আলমােড়া। পাইনে ঘেরা উপতের গলফ কোর্স থেকে সামান্য দূরে ‘কালিকা’। কালীমাতার মন্দির থেকে এ অঞ্চলের নাম হয়েছে কালিকা। টিলার ওপর অরণ্যময় পরিবেশে মন্দির। এ পথের সকল যাত্রী কী এক অজানা কারণে মন্দিরটি দর্শন করে যান। শােনা যায়, একসময় এই মন্দিরে নরবলিও হয়েছে। মন্দিরকে ডানদিকে রেখে এগিয়ে চলি মাঝখালির পথে। এ অঞ্চলে ভ্রমণার্থীরা সচরাচর আসেন না। মাঝখালি এক বর্ধিষ্ণু জনপদ। এখান থেকে হিমালয়কে অনেক কাছে বলে মনে হয়। মাঝখালির পরেই কাঠপুরিয়া। কাঠপুরিয়া থেকে ডানহাতি পথ গেছে শিতলাখেতে। দশ কিমি নির্জন বনভূমি পার হয়ে এসে পৌঁছলাম ৬,০০০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট শিতলাখেতে। শিতলাখেতের প্রায় প্রবেশ পথের বাঁদিকে গােবিন্দবল্লভ পন্থের স্ট্যাচু। নেহেরু জমানায় ইনি ছিলেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এই পার্বত্যভূমিতে পন্থজীর স্ট্যাচু কেন? ড্রাইভার মদনের তাৎক্ষণিক উত্তর পন্থজীর জন্ম শিতলাখেতের গ্রাম্য পরিবেশে। শিতলাখেত খুবই ছােট গ্রাম। পাহাড়ের ধাপে ধাপে ছড়িয়ে, ছিটিয়ে থাকা কিছু বাড়ি, আর পথের দুপাশে সারি সারি দোকান। স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে একটু এগিয়ে বাঁহাতি পাথুরে পথ উঠে গেছে কিছুটা উপরে। পথের শেষে কুমায়ুন বিকাশ মন্ডলের লজ। পাশেই বনদপ্তরের বাংলাে। বহুদিন আগে নির্মিত হয়েছিল। শােনা যায় ইংরেজ সরকারের প্রতিনিধি এক ফৌজি সাহেব শিকারের উদ্দেশ্যে লােকালয়বর্জিত এই অরণ্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তাঁরই সুপারিশে বনদপ্তর এখানে বাংলাে তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। (ট্যুরিস্ট লজের সামনে বিশাল লন। সামনে পাহাড়ের অরণ্যাকীর্ণ ঢল নেমে গেছে। উত্তর দিগন্তে হিমালয়ের অনুপম শিল্পকর্ম। শিতলাখেতে ভ্রমণার্থীদের ভিড় না থাকায় লজের ডর্মিটরিতে জায়গা পেতে অসুবিধা হল না। লজের ডানপাশ দিয়ে পথ উঠে গেছে আটশয্যাবিশিষ্ট ডর্মিটরিতে। লজের পিছনের অংশ ঘন বনে আচ্ছাদিত। পিথােরাগড়ে দেখা হওয়া এক বাঙালি দম্পতিকে এখানেও দেখলাম। দেখেই চিনতে পারলেন। ভদ্রলােক পক্ষীবিশারদ না হলেও পক্ষীপ্রেমিক তাে বটেই। রাতে ডাইনিং হলে খেতে খেতে বললেন, কুমায়ুন পাহাড়ের প্রায় সব জায়গা থেকেই হিমালয় দেখা যায়। কিন্তু শিতলাখেত ছাড়া এত পাখির আনাগােনা আর কোথাও পাবেন না। ওঁর দৃষ্টিতে শিতলাখেত – unedeclared birdsanctuary. রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর শীতের দাপটকে অগ্রাহ্য করে বাইরে লনে এসে দাঁড়াই। চারদিকে জমাট অন্ধকার। লনের শেষপ্রান্তে গিয়ে ডানদিকে তাকালে, চোখে পড়বে আলাের বিচ্ছুরণ। রাতের আলমােড়া ঝলমলিয়ে ওঠে। সমস্ত কুমায়ুন যদি গােল্ডচেন হয়, শিতলাখেত থেকে দেখা রাতের আলমােড়া হবে হীরক দ্যুতি। রাত যত বাড়ে শীতও তত জাঁকিয়ে পড়ে। বাইরে থাকা যায় না। ফিরে যাই ডর্মিটরিতে।।

খুব ভােরে ঘুম ভেঙে যায়। একে একে এসে সবাই জড়াে হয় লনে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রকৃতির দ্বারপথ স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ক্রমে পূবাকাশ উদ্ভাসিত হতে থাকে। প্রথমেই নন্দাদেবীর পূর্ব দিক লাল হয়ে ওঠে, তারপর সূর্যরশ্মির বর্ণচ্ছটায় প্রকট হয়ে ওঠে গিরিমালা। আমি স্তব্ধ, নির্বাক বাকিরা উল্লসিত, শিহরিত। একরাশ তৃপ্তি নিয়ে সবাই ফিরে যায়। আমি দাঁড়িয়ে থাকি একা। চোখ মেলে দেখি অসংখ্য পাখির আনাগােনা। কান পেতে শুনি তাদের কলকাকলী। পিথরাগড়ে দেখা হওয়া পক্ষীপ্রেমিক পাশে এসে দাঁড়ান। ফিস ফিস করে বলেন, এটা হচ্ছে Forest Wagtail ওই যে লম্বা ঠোঁট দেখছেন, ওটা হচ্ছে Little Spider hunter.  ভােরের তরতাজা মেজাজটা থাকতে থাকতে বেরিয়ে পড়ি গ্রাম্য দেবী দর্শনে, সিয়াহীদেবীর মন্দিরে। পক্ষীপ্রেমিক দম্পতি চলে যান কাটারমল সূর্যমন্দির হয়ে আলমােড়ায়। | মন্দির শিতলাখেতের আর এক বিস্ময়। শিতলাখেত ট্যুরিস্ট লজের ডানপাশ দিয়ে অরণ্যের বুক চিরে পথ চলে গেছে। সিয়াহীদেবীর মন্দিরে। দূরত্ব ৩ কিমির কিছু বেশি। নির্জন পথে যত এগিয়ে চলি, মনে হয় হিমাদ্রীশিখরগুলি তত যেন আমাদের সামনে এগিয়ে আসে। সারাটা পথ ছায়াঘেরা অরণ্যময়। বাঁদিকে সবটা পথ হিমালয় আমাদের যাত্রাসঙ্গী। ডানদিকে গভীর বনানী। আগে এ পথে দিনের বেলাতেও নাকি ডােরাকাটা অতিথিদের কখনও কখনও দেখা মিলত। এখন অবশ্য দেখা যায় না। লজের কেয়ারটেকার বলেছিল, সাবধানের মার নেই। দলবেঁধে একসঙ্গে যাওয়াই ভালাে। একটানা চড়াই পথ। মাঝে মাঝে দাঁড়াতে হয়। আর তখনি উত্তরের হিমেল হাওয়া হাড়ে কাপুনি ধরায়। এক কিমির মতাে যাবার পর হঠাৎ পাকদণ্ডি পথে উঠে আসে এক পাহাড়ি দম্পতি। সবকিছুতেই ওদের হাসি। পুরুষ সঙ্গীটির কোলে একটি ছাগশিশু। হাবভাবে বুঝিয়ে দেয় দেবীচরণে বলি চড়াতে চলেছে। ঘন্টা দুয়েক সময় লাগলাে মন্দিরে পৌঁছতে। মন্দিরের পাশেই পূজারীর পণ্যকুটীর। ডিসেম্বর মাসে বরফ পড়া শুরু হলে নেমে যায় আলমােড়ায়। এখানে দুটি মন্দির। প্রথমটি সিয়াহীদেবীর। স্থানীয়রা বলে শ্যামাদেবী। আমাদের প্রশ্নের উত্তরে পূজারী জানালেন যে, প্রায় ১৩০০ বছর আগে এই মন্দির নির্মিত হয়েছিল। দেবী ভগবতী, দেবী কালিকা এবং দেবী লক্ষ্মীর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে শ্যামাদেবী। পূজারীর বিশ্বাস, দেবী শ্যামা আসলে বৈষ্ণদেবীর ছােট বােন। শােনা যায়, চাদরাজাদের আমলে নলাখ কতুরে নামে এক সাধুবাবা এক রাতের মধ্যে নাকি মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। ৯ জন মানুষের পক্ষে বহনযােগ্য নয় এমন সব পাথরের বােল্ডার দিয়ে মন্দির গড়ার কাজ শেষ করেছিলেন বলেই নাকি সাধুবাবা নলাখ কতুরে নামে পরিচিত হয়েছিলেন। গ্রাম্য দেবতাকে নিয়ে গ্রাম্য উপাখ্যান। গর্ভগৃহে দেবীর ডানপাশে সিদ্ধিদাতা গণেশ এবং তার পাশে দেবী সরস্বতী। শ্যামাদেবীর মূর্তিটি কষ্টিপাথরের। চোখের মণিযুগল রূপাের। আর পাঁচটা উপজাতি দেবীর মতাে শ্যামাদেবীও বিকটদর্শনা। পুজারী জানালেন, নবরাত্রিতে এই নির্জন বনভূমি মেতে ওঠে। ধুমধাম করে পূজা হয়। জমজমাট মেলা বসে। মূল মন্দিরের পাশে ভৈর সাদামাটা ছােট মন্দির। দ্রাবিড়ভূমির মতাে হিমালয়ের এই সব মন্দির হয়তাে কারুকার্যশােভিত নয়। হয়তাে এইসব মন্দিরের শিল্পীরা মন্দিরের গায়ে ফুটিয়ে তুলতে পারেননি ভাস্কর্যের নিদর্শন। একথা ঠিক যে মানবসৃষ্ট শিল্পের কলাকৌশল এখানে অনুপস্থিত। কিন্তু বিশ্বশিল্পী তাঁর ক্যানভাসে অকৃপণভাবে সৃষ্টি করে চলেছেন তার শিল্পনৈপুণ্য। চোখ থাকলেই সর্বত্র দেখা যায় তার নিদর্শন। এইসব মন্দিরের পটভূমিতে আছে দিকচক্রবালের তুষারশােভিত গিরিমালা। আছে সমাহিত উপত্যকা। আছে স্রোতবতী নদীর চপলতা। আছে আরণ্যক পরিবেশে সুবাসিত বাতাসের তরঙ্গ। উত্তরের অমলধবল হিমালয়ের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। ভাবি হিমালয়কে আমি দেখেছি অনেকভাবে, অনেক দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু এমনভাবে তাে কখনও দেখিনি।

ছবি :. লেখক