দ্রুতগতিতে বিছানার আরাম ছেড়ে স্নান ও ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়ি। গন্তব্য আরিটার লেক, ঋষি নদী। যাওয়ার পথটা অসাধারণ। পাহাড় ঘুরে ঘুরে গাড়ি উঠছে, নামছে—দুপাশে কখনও শুনসান পাহাড়, জঙ্গল, কখনও বা ছােট ছােট জনপদ। স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা থেকে কর্মরত নারী-পুরুষ, সবাই ব্যস্ত। তার মধ্যেই অবাক আর ভালবাসার চোখে দেখে ওরা আমাদের। হাসি বিনিময় ক্ষণিকের। তারপর আবার এগিয়ে যাওয়া। আরিটার লেক সিকিমে। আর ঋষি নদী ঠিক দু রাজ্যের সীমানায়। নদীর উপর বিশাল ব্রিজ। ব্রিজ শেষ হলেই সিকিমে ঢােকার চেকপােস্ট।
প্রথমে সােজা আরিটার লেক। ঘন সবুজ জলের রং—শ্যাওলার পুরু স্তর বলেই হয়তাে। জলে ভাসমান রাজহাঁস, পাতিহাস। বােটিং-এর ব্যবস্থা আছে। তাতে সওয়ারি একদল এলাকার তরুণ-তরুণী। খুশি মনেই ছবি তােলার জন্য পােজ দেয় তারা। লেক ঘিরে গাছপালার আস্তরণ ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে রােদ। রােদের তাত বেড়ে ওঠার আগেই লেকের সুন্দর ও মনােরম পরিবেশ ছেড়ে আবার পথে নামি, এবার ঋষি নদী। অনেকটা নিচে নদী বয়ে চলেছে আপন ছন্দে। আমার দর্শন অবশ্য উপর থেকেই। অনেকটা চওড়া ও দীর্ঘ ব্রিজের উপর থেকে দেখি স্রোতস্বিনীকে। শীতল হাওয়ায় কাঁপন লাগে। শুনি নদীর কলতান। চারপাশে আর কোনও শব্দ নেই।
এরপর নিস্তবদ্ধতাকে বিদায় জানিয়ে পেডং ফেরা। পিছনে ফেলে এসেছি চেক পােস্ট। বিদায় সিকিম, এবারের মতাে। পথে রেনক বাজার। ছােট্ট এক অঞ্চল— ঘরবাড়ি, দোকানপাট। সেখানেই রামগৌরী সংগ্রহালয়। একেবারে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় এর প্রতিষ্ঠা করেন প্রয়াত রামু প্রধান। একশাে বছরের পুরনাে এই মিউজিয়ামে প্রাচীন ডাকটিকিট, মুদ্রা, গৃহস্থালী সরঞ্জাম (যেমন, ঘড়ি, হ্যারিকেন লণ্ঠন, বাসনপত্র, তালা-চাবি এবং আরও কত কী!) বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি। রামু প্রধানের ছেলে গনেশ কুমার প্রধান পরে বাবার মিউজিয়ামটির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। পাশাপাশি দেখার মতাে ওঁদের বনসাই সংগ্রহ। বিভিন্ন গাছের বনসাই ও ফার্নের বিপুল আয়ােজন। ১০০০ প্রজাতির গাছ আছে বলে জানা গেল। কিছু নমুনাও দেখলাম। পেডং থেকে আরিটার লেকের দূরত্ব ২৬-২৭ কিলােমিটার। আরিটার থেকে ঋষি ১২ কিমি। ঋষি থেকে পেডং ১৪-১৫ কিমি। ফ্রেশ হয়ে গরম চা আর মােমাে। সন্ধ্যা নামছে পেডং-এর আকাশে। আজ চাঁদ আরও উজ্জ্বল, আরও বড়। তােরজোড় শুরু বন ফায়ারের। কাঠকুটো জড়াে করছে ছেলের দল। রাতের খাবার খেয়ে সকলেই তাড়াতাড়ি লেপ-কম্বলের আশ্রয়ে। এখানে দিন শুরু ও শেষ দুটোই প্রকৃতির নিয়ম মেনে বেশ কিছুটা আগে, মানে কলকাতার তুলনায়।
পরদিন আরও একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়া, জ্ঞান ও প্রাতরাশের পালা চুকিয়ে। দিনটা রােদে মাখামাখি। আকাশ একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার। প্রথমে সাংচেন দর্জি মনাস্ট্রি। পেডং-এর সাক্যিয়ন রােডের এই মনাস্ট্রি মাত্র ২কিমি দূরত্বে অবস্থিত। ১৭৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত, সব থেকে পুরনাে গুম্ফাগুলির অন্যতম। প্রাচীনতার গন্ধ জড়ানাে এর সর্বাঙ্গে। রাস্তা থেকে অনেকটা উঁচুতে উঠে গেছে খাড়া সিঁড়ি। ঢােকার মুখেই বিশাল এক জপযন্ত্র যার গায়ে লেখা ‘ওঁ মণিপদ্মে হুম। গুম্ফার অভ্যন্তর বেশ অন্ধকার। সেই অন্ধকারকে কিছুটা দূর করেছে প্রদীপের আলাে, যা দিবারাত্র জ্বলছে। বুদ্ধ ছাড়াও বৌদ্ধদের আরাধ্য আরও নানা দেবদেবী আসীন এখানে। আছে প্রচুর দুষ্প্রাপ্য তৈলচিত্র। | মনাস্ট্রি থেকে বেরিয়ে ড্যামসাং ফোর্ট। দুরত্ব বড় জোড় ৫ কিমি। ফোর্ট ঘিরে রেখেছে জঙ্গল। কাঠ চুরির উপদ্রব এখন আর তেমন না থাকলেও, জঙ্গল হারিয়েছে তার ঘনত্ব। ড্যামসাং জঙ্গল ও দূর্গ প্রাচীন ইতিহাস ও উপকথার রহস্যে মায়াময়। পথ থেকে অনেকটা উঁচুতে উঠতে হবে, প্রায় দু'ঘণ্টার ট্রেক। তাই তার আগে ক্ষুন্নিবৃত্তি, যথারীতি মােমাে ও কফি সহযােগে।।
ড্যামসাং পর্ব শেষ করে আমরা এবার অন্য পথে। তার আগে অন্য একটি প্রসঙ্গ। নার্সারি এখানে ঘরে ঘরে, প্রায় কুটির শিল্পের পর্যায়ে পড়ে। ফুল, অর্কিড, পাতাবাহারের স্বর্গরাজ্য এই অঞ্চল। আর মানুষগুলিও বড়ই সৌন্দর্যপ্রেমী। প্রকৃতিপ্রেমীও বটে। প্রায় বিত্তহীন, শ্রমজীবি পরিবারগুলিও তাদের গৃহের অঙ্গনগুলি সাজিয়ে রাখেন ফুলের সমারােহে। আবার নিছক সৌন্দর্যবৃদ্ধিও নয়, রুটিরুজির ক্ষেত্রেও নার্সারি ব্যবসা অনেকটা সহায়ক হয় ওঁদের। আমি অবশ্য যে নার্সারিটির উল্লেখ করতে যাচ্ছি, সেটা মােটামুটি বড়ই। একজন রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার প্রতিষ্ঠা করেছেন এর। নানা জাতের ফুল, বাহারি অর্কিড, বনসাই দেখে মুগ্ধ হতে হয়। অসাধারণ এক রডােডেনড্রন প্রজাতি দেখলাম এখানে। | এবার গন্তব্য বারমেক। পেডং থেকে আলগড়া হয়ে যেতে হয় অনেকটা উঁচুতে পথ গিয়েছে ঘুরে ঘুরে। বারমেক মূলত সিঙ্কোনা প্ল্যান্টেশনের জন্য বিখ্যাত। অনেক নিচে ফিতের মতাে বয়ে চলেছে তিস্তা। তিস্তার দৈর্ঘ্য সম্পর্কে বেশ ভাল এক ধারণা মেলে এখান থেকে। আবার পথে। এবার যাব বারমেক শিবমন্দির ও জলসা বাংলাে। তার আগে ছােট্ট এক হল্ট। চা-পান, সঙ্গে কিছু তথ্য সংগ্রহ। সিঙ্কোনা প্ল্যানটেশনই বারমেকের মানুষের মূল জীবিকা। উচ্চতা প্রায় ৬০০০ ফুট। ব্রিটিশ আমলে সংগঠিতভাবে সিঙ্কোনা প্ল্যানটেশন শুরু এখানে। জলসা বাংলাে সেই সময় সাহেবদের থাকার জন্য তৈরি হয়। বারমেকের শিবমন্দি বেশ পুরনাে। মন্দিরের অভ্যন্তরটি সুন্দর সাজানাে। এই পরিবেশ মনে প্রশান্তি আনে। সারা বছরই ভক্তরা আসেন এখানে দূর দূর থেকে। আর শ্রাবণ মাসে শিব পুজোকে ঘিরে উৎসবের সাজে সেজে ওঠে বারমেক ধাম। । | হিমেল বাতাস থাবা বসাচ্ছে পেডং-এর শান্ত প্রকৃতির বুকে। দিন শেষ। সন্ধ্যা নামলে উজ্জ্বল চঁাদ পেডং-এর আকাশে। আবার তিস্তা, আবার সারি সারি পর্বতশ্রেণী, পাইনের মাথা নাড়া, মন খারাপের বিদায় বাঁশি শুনতে শুনতে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। তিস্তাকে বলি, আবার আসব ফিরে... আসব বার বার... আসব বলেই এবারের মতাে বিদায়!
ছবি : লেখক
0 Comments