দু’পাশে লাল হলুদ পাহাড়ের বিচিত্র আকৃতির দেওয়াল, মাঝে মধ্যে ছােট ছােট গুহা, মাঝখান দিয়ে সরু উঁচু নীচু পাথুরে রাস্তা গােলকধাঁধার মত এদিক ওদিক ছড়িয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন হারিয়ে গেছি বিখ্যাত হলিউডি ওয়েস্টার্ন ছবি ম্যাকেনাস গােল্ডের অবিস্মরণীয় শেষ দৃশ্যে। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি দূর থেকে এগিয়ে আসা ঘােড়ার পায়ের ক্ষুরের শব্দ। একটু বাদেই আমায় সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এখানের কোনও গুহার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সােনার সন্ধানে সামনে দিয়ে ছুটে যাবে দুই ঘােড়সওয়ার। পরনে কাউবয়ের পােষাক, মাথায় হেলানাে টুপি, কোমরের বেল্টে গোঁজা কাঠের হাতলের লম্বা পিস্তল। তার পরেই শুরু হবে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প। দু’পাশে সামনে পিছনে ভেঙে পড়তে থাকবে বড় বড় পাথরের চাই। ভেঙে পড়বে সামনের পাহাড়ের মাথায় হলদে পাথরের সিংহের মাথাটাও। বেরােবার পথ খুঁজে না পেয়ে হয়ত চিরতরে আটকে যাব এখানেই। কিন্তু এসব কি উল্টোপাল্টা ভাবছি, একটু আগেই তাে টিপিক্যাল বাঙালি তেলেভাজার দোকানের সামনে নড়বড়ে বেঞ্চে বসে এখানকার বিখ্যাত আলুর চপ আর মুড়ি খাচ্ছিলাম সঙ্গে চা। তবে পুরাে ব্যাপারটাই কিন্তু স্বপ্ন নয়। কারণ চোখের সামনেই এখনও অবিচল স্থির প্রকৃতির খামখেয়ালীপনায় তৈরি গুহাটার মাথায় ওই তাে হলুদ রঙা সিংহের মুখটা। সবটাই আদতে স্থান কাল মাহাত্মের ব্যাপার। ভনিতা ছেড়ে আল গল্পটা শুরু করা যাক।
বাংলার এক নদীর নাম শিলাবতী। জন্ম পুরুলিয়ার পাহাড়ে। বাঁকুড়া মেদিনীপুর জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় দ্বারকেশ্বর নদীর সঙ্গে মিলে হুগলী জেলায় ঢুকে রূপনারায়ণ নাম নিয়ে ভাগীরথীতে মিশে সােজা সাগর সঙ্গমে। রাঢ় বঙ্গের লালমাটির দেশের বাঁকুড়া জেলার সীমানার কাছাকাছি গড়বেতায় শিলাবতীর উঁচু পূর্ব তীর কোনও বিশেষ ভৌগলিক কারণে লালচে হলুদ রঙের জমাট বাঁধা শক্ত পাথরে তৈরি। সুদূর অতীতে জলভারে সমৃদ্ধ শিলাবতী বইত এই পাথরের গা বেয়ে। আজ নদীর জলতল নেমে গেছে শতাধিক ফুট। কিন্তু সেই স্রোতস্বিনী তার অতীত প্রবাহের সাক্ষ্য রেখে গেছে পাথরের গায়ে, সৃষ্টি করে গেছে অপরূপ প্রাকৃতিক ভাস্কর্য্যের। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার উর্বর নিম্ন ভূমি, যার ধারে কাছে কোনও মরুভূমির অস্তিত্বই নেই সেখানে উন্মুক্ত আকাশের নীচে জমাট বাঁধা ল্যাটেরাইট পাথরের গায়ে কিভাবে সৃষ্টি হল এই প্রাকৃতিক ভাস্কর্যের সেটাই এক আশ্চর্যের ব্যাপার। আমেরিকার অ্যারিজোনা প্রদেশের কলােরাডাে নদীর পার্বত্য গিরিখাতের এক মিনি সংস্করণ হিসাবে তুলনা করা যায় গনগনি খােলায় শিলাবতীর এই নদীখাতের। এজন্যই গনগনির নদীখাত বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন অভিধায় অভিহিত।
সড়ক পথে আরামবাগ, সেখান থেকে কামারপুকুর হয়ে চার ঘণ্টার যাত্রা শেষে গড়বেতা পৌছলাম এগারােটা নাগাদ। প্রথমেই গিয়েছিলাম শহরের বিখ্যাত জাগ্রতা দেবী সর্বমঙ্গলার মন্দিরে। উড়িষ্যা ঘরানার নির্মিত ত্রিরথ ভূমির ওপর ল্যাটেরাইট পাথরের রেখ দেউল মন্দির। সামনে পীড়া দেউলের জগমােহন। যার দেওয়ালে স্টাকুর কাজে চৌষট্টি যােগিনী আর নাগকন্যা। গর্ভগৃহে কালাে পাথরের দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী। অনুমান করা হয় ষােড়শ শতাব্দীতে এই অঞ্চলের রাজা নৃপতি সিংহ মন্দিরটি তৈরি করান। তবে সামনের চারচালা নাটমন্দিরটি পরে তৈরি হয়। মন্দিরের সামনে রাস্তার উল্টো দিকে একটা বহু পুরানাে বাড়ির দোতলার দেওয়ালের গায়ে হঠাই নজরে পড়ল একটা স্টাকুর কাজ। খড়খড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন একজন স্ত্রীলােক। কোনও বসত বাড়ির বাইরের দেওয়ালে এ জাতীয় জিনিস আগে কোথাও দেখিনি। ফেরার পথে চোখে পড়ল প্রায় তিরিশ ফুট উঁচু এক প্রাচীন পঞ্চরত্ন টেরাকোটার মন্দির। যার সামনের দরজার দু'পাশে দুই দ্বারপাল। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন লােকেরা এটাকে মুকুটঘর বলে। ইংরেজ রাজত্বকালে এখানের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি রাধানাথ সিংহের স্মৃতি রক্ষার জন্য নাকি মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল। ওঁরা জানালেন গড়বেতায় নাকি এরকম পুরনাে মন্দির আরও অনেক আছে।
সূর্য মাথার ওপর থেকে সবে পশ্চিমে সরতে শুরু করেছে দেখে আর দেরী না করে ষাট নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে এক ধাবায় সেরে নেওয়া হল দুপুরের খাওয়া। তারপর গুগুল দেখানাে পথ ধরে গড়বেতা কলেজের থেকে একটু এগিয়ে সামনেই দেখলাম বাের্ডে লেখা গনগনি খােলা যাওয়ার পথ নির্দেশিকা। পাকা রাস্তা ছেড়ে ধরলাম লাল মাটির কাঁচা পথ, দু’দিকে ছােট গুল্মের জঙ্গল আর কাজুবাদামের গাছ, এঁকে বেঁকে পথ গিয়ে শেষ হল এক বিরাট খােলামাঠের মাঝে শিলাবতীর তীরে। মাঠের ওপর এক পাশে দাঁড়িয়ে অনেক গাড়ি। রিজার্ভ বাসও রয়েছে খান দুয়েক। চা, কেক, বিস্কুট, পানীয় জলের বােতল, ফুচকা, আখের রস এই সব পসরা নিয়ে অনেক অস্থায়ী ছাউনির দোকান। নদীর তীরে পঞ্চায়েতের বানানাে পিকনিকের জন্য শৌচাগারের ব্যবস্থা সহ পাকা ছাদের এক বিশাল বাঁধানাে শেড, অনেক নীচে প্রায় শ'খানেক ফুট হবে, প্রশস্ত নদীর চড়া যার মাঝখান দিয়ে তির তির করে বয়ে চলেছে শীতের শিলাবতীর শীর্ণ অগভীর জলের ধারা। শীতের ছুটির দিন ভিড় করেছে বনভােজনে ব্যস্ত ছেলেমেয়ের দল, বয়স্ক মানুষজনেরাও আছেন। আমাদের মত শুধুই বেড়াতে আসা লােক প্রায় নেই বললেই চলে।
ওপর থেকে তাকিয়ে দেখছিলাম চারপাশ। আরে ওটা কি? আমাদের বাঁ পাশে সামনে বেঁকে যাওয়া হলুদ রঙা পাথুরে নদী খাতের গায়ে অনেকটা অরণ্যদেবের খুলি গুহার মত দেখতে, ওটা কি কোনও মন্দির, প্যাগােডা, নাকি কোনও প্রাকৃতিক গুহা? যার সামনের দরজা থেকে নেমে অনেক গুলাে পায়ে চলা শরু রাস্তা ছড়িয়ে গেছে এদিক ওদিক। পাশে মনে হচ্ছে আরও কয়েকটা মন্দির রয়েছে যার চূড়াগুলাে শুধু দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। কি দেখছেন অমন হাঁ করে? ফিরে দেখি একজন স্থানীয় মানুষ। বললেন ওটা হচ্ছে বকাসুরের গুহা। বনবাস পর্বে পান্ডবেরা কিছুকাল বাস করেছিলেন একচক্রা গ্রামে। ভয়ঙ্কর বকাসুরের ভয়ে অতিষ্ঠ গ্রামবাসীদের অনুরােধে মধ্যম পান্ডব ভীমসেন এসেছিলেন, এখানে বকাসুরের আস্তানায়। ভীষণ যুদ্ধ হয়েছিল দু’জনের মধ্যে, শেষে বকাসুরকে নিধন করেছিলেন ভীম। | একটা ঘােরের প্রভাবে ঘুরে বেড়াই পাহাড়ি ভুলভুলাইয়ায়, তারপর পাথরের দেওয়ালে অযত্নে অবহেলায় বেড়ে ওঠা কাটা গুল্মের ঝােপকে এড়িয়ে মাঝের আঁকা বাঁকা সরু পায়ে চলা পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অকস্মাৎ নিজেকে আবিষ্কার করি শিলাবতীর পাশে তার বহমান স্বচ্ছ নীল জলের ধারে। একদিকে নদীর ওপর দৃশ্যমান দূরবর্তী রেলসেতু, অন্যদিকে দূরে দেখা যায় অনেক উঁচুতে পিকনিক শেডের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলােকে। নদীর তীর ধরে ধীর লয়ে মন্থর চরণে ফিরে আসি সেখানে। অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভায় রঞ্জিত গনগনিখখালা তখন এক অবর্ণনীয় অদ্ভুত মায়াবী রূপ ধারণ করতে শুরু করেছে। গাড়ির হর্নের আওয়াজে বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সেই অপরূপ রূপের স্বপ্নের জগৎ থেকে বাস্তবের মাটিতে ফিরে আসে হিসেবী মন। রাস্থা ধরি ঘরে ফেরার।
ছবি- লেখক
0 Comments