আশিসকুমার ঘোষ


কেনিয়ার সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে জনপ্রিয় বন্যপ্রাণী দর্শনের স্থান হল মাসাইমারা ন্যাশানাল রিজার্ভ। বিস্তির্ণ এলাকা জুড়ে ঢেউখেলানো ঘাসের জঙ্গল আর তার মাঝে মাঝে ঝোপঝাড় আর মাথা উঁচু করে আছে কঁাটাওলা অ্যাকাশিয়া গাছ। আর সেই ঘাসজমিতে হাজারে হাজারে ওয়াইল্ড বিস্ট, আর জেব্রার বিচরণ। এর সঙ্গে গিজ গিজ করছে অন্য বন্যপ্রাণী। শুধু ওয়াইল্ড বিস্ট নয়, তার সঙ্গে তৃণভোজী নানা ধরণের হরিণ, জিরাফ, গন্ডার, হাতি, বন্য মহিষ, ইমপালা, রিডবাক প্রভৃতিও এই জঙ্গলকে তাদর ঘরবাড়ি করে তুলেছে। আর এর পিছনে রয়েছে মাংশাসী প্রাণীর দল। চিতা, লেপার্ড, স্পটেড হায়না, শিয়াল আর অবশ্যই সিংহ। কেনিয়ার জঙ্গল ভ্রমণে এসে আমাদের শেষ গন্তব্য এই মাসাইমারা। কলকাতার এক ভ্রমণ সংস্থার মাধ্যমে আমরা এই অরণ্য ভ্রমণে এসেছি।  দলে পঁচিশ জন ভ্রমণাথরী আর কোম্পানির  একজন টু্যর ম্যানেজার এই সফরে এসেছে। কলকাতা থেকে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির কোনও সরাসরি উড়ান নেই তাই মুম্বই থেকে নাইরোবি। তারপর নাইরোবিতে এক রাত কাটিয়ে আমরা একে একে ঘুরে এসেছি আম্বোসেলি ন্যাশানাল পার্ক, ওল পেজেটো সংরক্ষিত অরণ্য, নাইভাসা লেক আর নাকুরু ন্যাশানাল পার্ক। নাইভাসা লেকের এক রিসর্ট থেকে আমরা চলেছি সরাসরি মাসাইমারার উদ্দেশ্যে। ব্রেকফাস্ট সেরেই বেরিয়েছি।  পথে ঘণ্টাখানেকের জন্য লেক নাইভাসায় হিপোদের সান্নিধে্য বোটিং করে টানা দৌড়। আমরা চলেছি চারটি ফোর হুইল টয়েটো গাড়িতে ভাগাভাগি করে। এই গাড়িগুলি বেশ শক্তপোক্ত। একই সঙ্গে হাইওয়ে ও অরণ্য ভ্রমণের উপযুক্ত। অরণ্য ভ্রমণের সময় গাড়ির মাথার ছাদ অনেকটা ওপরে উঠিয়ে দেওয়া যায়। তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বন্য প্রাণী দর্শন ও ছবি তোলা যায়।

মাসাইমারা ও অন্যান্য ন্যাশানাল পার্কগুলি হল সংরক্ষিত অরণ্য। এগুলির বিশেষত্ব হল এখানে বসবাস, শিকার বা গবাদি পশু চরানো যায় না। মাসাইমারা হল মাসাই উপজাতিদের এলাকা তেব ইতিহাস বলে মাসাইরা এখানকার ভূমিপুত্র নয়। এরা এসেছে নীলনদের আশপাশের এলাকা থেকে। দু’ তিনশো বছর আগে এদের একটি দল সুদান থেকে দক্ষিণে নেমে আসে এবং উত্তর কেনিয়ার লেক তুরকানা থেকে তানজানিয়ার নাগোরোংগোরো পর্যন্ত অর্থাৎ আফ্রিকার গ্রেট রিফট ভ্যালির মধ্যে এবং দু’পাশে বসবাস শুরু করে। মাসাইরা চাষবাস করে না। গো—পালন ও শিকারই তাদের জীবিকা। তিনশো বছরে আফ্রিকার বুকে নানা পরিবর্তন হয়েছে। ইউরোপের নানা দেশ এখানে কলোনি স্থাপন করল, আফ্রিকার নানা দেশ স্বাধীন হল, রেলগাড়ি চলল, মোটর চলল, আকাশপথে যোগাযোগ সৃষ্টি হল, কিন্তু কিছুই মাসাইদের স্পর্শ করেনি। ওদের নিজেদের ধর্ম আলাদা। হাতে ইস্পাতের ফলা লাগানো বল্লম আর ইস্পাতের ছুরি, গায়ে লাল মোটা সুতির চাদর, যদিও মেয়েদের গায়ে রং—বেরঙের চাদর। বন্যপ্রাণী দর্শনের পর এই মাসাইদের নিকটবর্তী গ্রামে যাওয়ার পরিকল্পনাও আছে।

বেলা দু’টো নাগাদ মধ্যাহ্নভোজের বিরতি থামল এক ধাবা শ্রেণীর দোকানে। এখানে খাবার বেশ নিম্নমানের, ভাত, কালো ডাল, সব্জি আর চিকেনের ঝোল। চিকেনের টুকরোগুলো সুসিদ্ধ নয়, তাই খাওয়া গেল না। খাবার দোকানের ধারেই কিউরিওর দোকান। আফ্রিকার হস্তশিল্প বিখ্যাত। সেখানে কাঠের ও পাথরের ছোটবড় শিল্পকর্ম। তার মধ্যে এবনি কাঠের হাতি, গন্ডার, জেব্রা, জিরাফ, মাসাইদের মুখ, মুখোশ ইত্যাদি। এছাড়া মেয়েদের কানের দুল, পাথরের মালা...। অনেকেই কেনা কাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এখান থেকে বেশ কয়েক বোতল পানীয় জল কিনে নিলাম। কেনিয়ায় পানীয় জল বেশ মহার্ঘ্য। হোটেলে দিনে আধ লিটার আর ভ্রমণ সংস্থাও আধ লিটার করে মাথাপিছু জল সরবরাহ করে। ফলে বাকিটা কিনতে হয়। জলের মূল্য ১ লিটার বোতল ৫০—৭০ কেনিয়ান শিলিং। বলা হয়নি, কেনিয়ার মুদ্রা হল কেনিয়ান শিলিং। এক ডলারের সঙ্গে বিনিময় মূল্য হল ১০০ কেনিয়ান শিলিং। বিমান বন্দরেই কিছু ডলার ভাঙিয়ে কেনিয়ার মুদ্রা সংগ্রহ করে নিয়েছি স্থানীয় কেনাকাটার জন্য।

আরও বেশ কিছুক্ষণ চলার পর গাড়ি নারোক শহরে এসে দাঁড়াল। এখানে এসি রেস্তোরাঁ রয়েছে সঙ্গে বিশাল কিউরিও দোকান। এখানে বিদেশী সাহেব মেমদের খুব আনাগোনা। সবাই মাসাইমারা থেকে ফিরছে অথবা সেদিকেই যাচ্ছে আমাদের গাড়ির ড্রাইভার কাম গাইডের নাম হল ক্রিষ্টোফার ওরফে ক্রিশ। ছ’ফুটের ওপর লম্বা, মাথা ন্যাড়া, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, বলিষ্ঠ গড়ন, জাতিতে মাসাই। তবে ক্রিশ খুবই স্মার্ট আর ইংরেজী বলে অনর্গল। ক্রিশ জানাল নারোকের পরবর্তী ৩০—৪০ কিলোমিটার রাস্তা খুবই খারাপ কারণ রাস্তা নতুন করে তৈরি হচ্ছে। যদিও কাজ এখনও অনেকটাই বাকি। গাড়ি সচল হল, সতি্যই মনে হল এই রাস্তায় কোমরের হাড়গোড় আস্ত থাকবে বলে মনে হল না– ওরাই বলে এটা ডান্সিং রোড। শুধু উঁচু নীচু খারাপ রাস্তা নয়, সঙ্গে ধুলো। ধুলোর জ্বালায় গাড়ির সমস্ত জানালা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। একেবারে দমবন্ধ করা পরিস্থতি। গাড়ির মধ্যে দরদর করে ঘামছি সকলে। মাঝে মাঝে অবশ্য রাস্তা বেশ মসৃণ। কারণ যে সমস্ত জায়গায় রাস্তা মেরামত সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। নারোকের পরই যেন নরক। রাস্তার দু’ধারে আফ্রিকার পরিচিত দৃশ্য। মাইলের পর মাইল পতিত জমি কখনও ঘাসে ঢাকা কখনও বা ন্যাড়া। তারই মাঝে মাঝে কাঁটাগাছ ঝোপ—ঝাড়। কখনও সখনও দু—একটা দলছুট জেব্রা বা ওয়াইল্ড বিস্ট দেখা যাচ্ছে। গাড়ি এবার বড় রাস্তা ছেড়ে গ্রামের পথ ধরল। পুরো মেঠো পথ মাঝে মাঝে বিরাট বিরাট গর্ত, সে সব বাঁচিয়ে গাড়ি চলছে। ক্রিশ জানাল এটা নাকি মাসাইমারা যাওয়ার বাইপাস আমার ধারনা সর্টকাট। এবার মাসাই গ্রামের মধ্যে দিয়ে পথ। দেখা গেল মাসাইরাও বেশ বুদ্ধিমান হয়ে গেছে। বেড়ার গেট দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। গেটের বাইরে দু’তিন জন দঁাড়িয়ে। আমাদের ড্রাইভারদের সঙ্গে তাদের কথাবার্তায় বোঝা গেল গাড়ি যেতে হলে তার জন্য মূল্য দিতে হবে। দরাদরি করে গাড়ি পিছু ৫ ডলার করে আদায় করল। তবেই গাড়ি এগোবার অধিকার পেল। গ্রামের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চলছে, মাসাই বাচ্চারা এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। গ্রাম পেরিয়ে আরও আধঘণ্টার মত গ্রাম্য রাস্তায় গাড়ি চলল। তারপরই আমরা পৌঁছে গেলাম ‘এনকোর ওয়াইল্ড লাইফ ক্যাম্পে’। এখানেই আমাদের দু’দিন থাকার ব্যবস্থা। মাসাইমারা ন্যাশানাল রিজার্ভের প্রবেশদ্বার এই ক্যাম্প থেকে মাত্র ১ কিমি দূরে। ক্যাম্পের অবস্থানটা বেশ সুন্দর। চারদিকে জঙ্গলে ঘেরা কোথাও ফেনসিং নেই অর্থাৎ বন্য জন্তু জানোয়ার ঢুকে আসতে পারে যে কোনো সময়ে। ক্যাম্পটি ওলউলআইমুটিয়া (Oloolaimutia hills) পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত ক্যাম্পে বিভিন্ন মানের টেন্ট রয়েছে, ছোট বড় সাধারণ লাক্সারি সব রকমই আছে। এখনও দিনের আলো রয়েছে একটু পরেই সূর্য অস্ত যাবে। রিশেপসনের সামনে আমরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে—বসে আছি। গাড়ি থেকে মালপত্র সব নামানো হয়ে গেছে এবার টেন্ট বন্টন হবে। ক্যাম্পেরই এক কর্মচারী ক্যাম্পের কিছু নিয়ম—কানুন জানিয়ে দিল। তবে টেন্ট বন্টন করতে গিয়ে দেখা দিল এক বিপত্তি। দেখা গেল আমাদের ২৫ জনের মধ্য ৯ জনের টেন্ট বুকিংই হয়নি। আমাদের আমাদের ম্যানেজারের কাছে কিন্তু ২৫ জনের বুকিং—এর প্রমাণপত্র রয়েছে। এরপর বিস্তর বাদানুবাদের পর কয়েকটি অব্যবহৃত টেন্ট পরিষ্কার করে, একই টেন্টে অতিরিক্ত (একই পরিবারের) গেস্ট ঢুকিয়ে পরিস্থিতি আজ রাতের মত সামাল দেওয়া হল। যখন ঘরের দখল পেলাম তখন রাত আটটা। ঘরের ব্যবস্থাও ভাল নয়, বেড মোটেই ভাল মানের নয়, একটি টেবিল রয়েছে কোনও চেয়ার নেই। সংলগ্ন সাজঘর, ওয়াস বেসিন সহ স্নানঘর ও টয়লেট সবই আলাদা আলাদা। টয়লেটের ফ্লাস ভালভাবে কাজ করছে না। কোনও তোয়ালে সাবান দেওয়া হয়নি। এই ক্যাম্পে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বিদু্যৎ থাকে (সৌরবিদ্যুৎ) এরপর সব অন্ধকার নিজেদের টর্চ বা মোমবাতিই সম্বল। রাত ৯টায় ডাইনিং হলে গিয়ে দেখি খাবার প্রায় শেষ, কারণ আয়োজনই তো কম হয়েছে। কপালে শুকনো নুডলস আর বিনস তরকারী জুটল। মোবাইল বা ক্যামেরার ব্যাটারি চার্জের ব্যবস্থাও এই ডাইনিং হলে বা ঘরে নেই। রাতে এদিক ওদিক ঘোরা নিষিদ্ধ কারণ যেহেতু এটি খোলা ক্যাম্প, জন্তু জানোয়ারের আগমন অসম্ভব নয়। ঘরে ঢুকে দরজার চেন লাগিয়ে শুয়ে পড়ি। কাল ব্রেকফাস্ট সেরেই শুরু হবে মাসাইমারারয় প্রথম গ্রেমড্রাইভ।

ভোরেই ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে এসে টেন্টের বারান্দায় দঁাড়াই। বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। এখন জুলাইয়ের শেষ, কেনিয়ায় জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর শীতকাল। টেন্টের দিকে একটু নজর দিই। টেন্ট নির্মিত হয়েছে মোটা খাকি ক্যানভাস ও স্থানীয় কাঠ দিয়ে। মাথার চাল মাকুটি ঘাস দিয়ে তৈরি আশা করা যায় বৃষ্টি হলে ঘরে জল ঢুকবে না। বাথরুমে গরম জল পাওয়া গেল না। কোনও মতে গায়ে মাথায় একটু ঠাণ্ডা জল ছিটিয়ে প্রস্তুত হয়ে ডাইনিং হলের দিকে যাই। আজ অবশ্য খাবারের ব্যবস্থা আছে টোস্ট মাখন পরোটা বেকড বিনস আর ডিমের ওমলেট। এছাড়া চা ও কফি।

‘মাসাইমারা’–স্থানীয়রা আদর করে ডাকে ‘মারা’। এর অবস্থান তানজানিয়ার বিখ্যাত জঙ্গল সেরেঙ্গেটির ঠিক উত্তরে। এই মাসাইমারা জঙ্গলের দায়িত্ব যুগ্মভাবে আছে নারোক কাউন্টি কাউন্সিল আর মারা কনসারেডন্সি সংস্থা। এই জঙ্গল ও বন্যপ্রাণী দর্শনের সেরা সময় হল জুলাই থেকে অক্টোবর। শীতকালটা ওয়াইল্ড বিস্ট জেবরা ও অন্যান্য অ্যান্টিলোপ ও তৃণভোজীরা কেনিয়ার মাসাইমারাতে কাটায়। সংলগ্ন সেরেংগেটি জঙ্গলের তৃণভোজীরা তখন সেখানে ঘাসের অভাবে দলে দলে অর্থাৎ হাজারে হাজারে মাসাইমারার দিকে পাড়ি দেয়। সেরেংগেটির ঘাস জলের অভাবে পুড়ে হলদে হয়ে গেছে। অক্টোবরের শেষে এখানে বৃষ্টি শুরু হয়। কয়েকদিনের মধ্যেই সেরেংগেটির ঘাস গজিয়ে ওঠে। ঘাসের ফুল হাওয়ায় দোলে। সেই ঘাস খেতে ওয়াইল্ডবিস্টরা মাসাইমারা থেকে দলে দলে নেমে আসে। ফেব্রুয়ারী থেকে এপ্রিল মাসের ঘোরতর বর্ষায় ঘাস আরও বড় হয়। অ্যাকাশিয়া গাছেও ধরে নতুন পাতা। ওয়াইল্ড বিস্টরা মনের আনন্দে চরে বেড়ায়। তাদের সঙ্গে থাকে জেবরা, বুনো মোষ, জিরাফ, হরিণের দল। তাদের পিছনে আসে সিংহ, চিতা, হায়না প্রভৃতি মাংশাসী জন্তু আর আকাশে শকুনের পাল। এই হল পৃথিবী বিখ্যাত সেই মাইগ্রেশন। যা দেখতে ভ্রমণার্থীরা ভিড় জমায় কেনিয়া তানজানিয়ায়। মানুষের চোখে ধরা না পড়লেও প্রাণীদের এইতুমুল সমাবেশে আসে অনেক নতুন মুখ, আগের যাত্রায় হারিয়েও গেছে অনেকে। পায়েড পাইপারের মত জলভরা মেঘ ২০ লক্ষের বেশী প্রাণকে এক দেশ থেকে অন্য দেশে টেনে নিয়ে যায় আবার ফিরিয়ে দেয় সূচনাস্থলে। নিরন্তর মঞ্চস্থ হয়ে চলে জন্ম মৃতু্যর চিরন্তন নাটক।

আমরা এখন মাসাইমারা ন্যাশানাল রিজার্ভের প্রবেশদ্বারের সামনে। গাড়িগুলোকে স্থানীয় মহিলারা ছেঁকে ধরেছে তাদের হস্তশিল্পের সম্ভার নিয়ে। দোকানের থেকে না নিয়ে এদের কাছে কিনলে অনেক সস্তায় কিন্তু পাওয়া যায় হস্তশিল্পগুলি। তবে প্রচুর দরাদরি করতে হয়। অনেক দরাদরি কেরে ৫ ডলারে (৫০০ কেনিয়ান শিলিং) কিনলাম একজোড়া কাঠের মুখোশ। গেটে অনুমতি পাওয়া গেছে আমরা প্রবেশ করলাম মাসাইমারা ন্যাশানাল রিজার্ভের অন্দরে। মাসাইমারায় আদিগন্ত সাভানার রাজসিক রূপ। বড় গাছপালার অরণ্য নয় অনন্ত বিস্তৃত ঘাসজমি, কখনও ছোট ছোট কখনও দীর্ঘ ঝোপঝাড় আর তার মাঝে কঁাটাওলা অ্যাকাশিয়া গাছ মাথা তুলে রয়েছে। সাভানা শব্দের অর্থ হল অনন্ত—প্রান্তর। তাতে বিচরণরত অগুনতি তৃণভোজী প্রাণী। তার মধ্যে শাবকের সংখ্যাও অনেক। যত দূর দেখা যায় বন্য সাভানা ঘাসজমি। বহু যোজন দূরে আকাশের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। অনন্ত ঘাসজমি জুড়ে অগুন্তি কালো ফুটকি। প্রতে্যকটি ফুটকি কোনও না কোনও প্রাণী। মাসাইমারায় আমাদের বন্যপ্রাণী দর্শনের বউনি হল জিরাফকে দিয়ে। জিরাফ তার বিরাট লম্বা গলা তুলে কঁাটাগাছের মগডাল থেকে পাতা খাচ্ছে। মনে পড়ে গেল ফেলুদার কাহিনীতে লালমোহনবাবুর উক্তি, ‘আচ্ছা তারা কি কঁাটা বেছে খায়? এরপর দেখা গেল জিরাফের এক বড় দল নানা ভঙ্গিমায় ঘুরছে অথবা গাছের পাতা খাচ্ছে। এবার ক্রিশ চিনিয়ে দিল হরিণ প্রজাতির আর এক অ্যান্টিলোপের সঙ্গে– নাম তার টোপি। এরা মাঝারি আকারের এই সাভানা অঞ্চলেই তাদের বাস, টোপি খুব দ্রুতগামী প্রাণী। দেখলাম ওয়াটার বাক আর এলান্ড, এরাও অ্যান্টিলোপ গোত্রীয়। ওয়াটার বাক কিন্তু জল বা জলাভূমি মোটেই পছন্দ করে না গায়ের রং ধুসর, পুরুষ ওয়াটার বাকের স্প্রিং—এর মত প্যাচানো শিং। এলান্ড হল লালচে বাদামী রঙের গরুর মত শিং আর লেজ। হঠাৎ ক্রিশ বলল, ওই দেখো ওয়াইল্ড বিস্টের দল চলেছে। পাশাপাশি পাঁচ ছ’টা করে জানোয়ার লাইন করে রাস্তা পেরোচ্ছে। সে লাইনের শেষ বা শুরু নেই। কয়েক কিলোমিটার ধরে সে লাইন আমাদের গাড়ির সঙ্গে সমান্তরালভাবে চলেছে। ওয়াইল্ড বিস্টের চেহারা বড় অদ্ভুত। এরা নু্য নামেও পরিচিত। আকারে একটা ছোটখাটো ঘোড়ার মত, তৃণভোজী, মুখটা গরুর মত, শরীরটা হরিণের মত আবার রামছাগলের মত দাড়ি আর বেঁটে বেঁটে শিং। আমাদের গাড়ির পথ কেউ আটকাল না। এগিয়ে পিছিয়ে দাঁড়াল। আমরা চলে গেলাম। ওয়াইল্ড বিস্টের কিন্তু শেষ নেই। মাসাইমারার মাঠে অসংখ্য ওয়াইল্ড বিস্ট ঘুরছে ঘাস খাচ্ছে আর তার সঙ্গে দেখা যাচ্ছে অসংখ্য জেব্রাকে। তারা কখনও নিজেদের আলাদা দলে আছে আবার কখনও ওয়াইল্ডড বিস্টের সঙ্গে মিলেমিশে আছে। ওয়াইল্ড বিস্টের সঙ্গে জেব্রার খুব ভাব। জেব্রারা জানে কোথায় জল পাওয়া যাবে আর ওয়াইল্ড বিস্ট ঘাসের গন্ধ পায়। জেব্রার গায়ের চামড়া চকচকে। গায়ের ডোরাকাটা দাগের জন্যেই ওরা তাপ সহ্য করতে পারে আর ওই সাদা—কালো দাগ জেব্রাকে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করে।

আচমকা আমাদের দৃষ্টির সামনে এল একটা বিশাল পাখি, পাঁচ ফুট উঁচু, সারা শরীর সাদা পালকে ঢাকা, লেজের কাছটা কালো, চোখের চারদিকে কমলা রঙের বর্ডার, মাথায় ঝুটি। ক্রিশ পরিচয় করিয়ে দিল এগুলি হল সেক্রেটারী বার্ড, আফ্রিকার সেরা স্নেক হান্টার। পাখিটি কোনও দিকে না তাকিয়ে হটমট করে চলে গেল। থমসন গ্যাজেল খুব রোগা পাতলা দ্রুতগামী হরিণ লম্বা লম্বা সরু সরু পা। তারা হাওয়ার বেগে এল আর চলে গেল। এতক্ষণ মাসাইমারায় কোনও হাতির দেখা পাইনি, দূর থেকে এক পাল হাতির দেখা পাওয়াতে গাড়ি সেই দিকে ছুটল। আফ্রিকান হাতি কিন্তু ভারতীয় হাতির থেকে অনেকটাই বড়। তাদের কানের আকৃতিও আলাদা। আর সব চেয়ে মজার হল এদের ছোট বাচ্চাদেরও দাঁত দেখা যায়। বড়দের তো বিশাল গজদন্ত। হাতির পালে পঁাচ ছ’টি হাতি বাচ্চা সহ রয়েছে। বিশেষ নড়াচড়া করছে না, আমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে এগিয়ে চলি। হঠাৎ ক্রিশের রেডিও যন্ত্রে কিসের বার্তা এল, সে গাড়ি ঘুরিয়ে উল্টো দিকে ধুলো উড়িয়ে গাড়ি ছোটাল। আমাদের অন্য গাড়িগুলিও অনুসরণ করল। বেশিদূর যেতে হল না, একটা বাঁকের পরেই দেখা গেল এক জোড়া বিশালাকার সিংহ ঠিক আমাদের গাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলেছে। কিন্তু তাদের মুখ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। রাস্তা থেকে তারা তৃণভূমিতে একবার নামল তারপর রাস্তা পেরিয়ে উল্টো দিকে চলতে লাগল। এবার আমরা সিংহ দু’টির মুখোমুখি। প্রথমে একটু বিমোহিত হয়ে গেলেও এবার ক্যামেরার শাটার টিপে যেতে লাগলাম। এক একটা পোজে এক একটা ছবি কখনও জোড়া কখনও আলাদা আলাদা। সিংহদুটির কিন্তু কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা যেন স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ করে জোড়ায় হেঁটে যাচ্ছে তারপর হাঁটতে হঁাটতে বড় ঘাসের জঙ্গলে হারিয়ে গেল। দুটো অস্ট্রিচ পাখি ঘাস জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পোজ দিল, তাকে বিশেষ পাত্তা দেওয়া হল না। রাস্তার পাশ দিয়ে একটা বেশ বড় নালা বয়ে চলেছে। সেখানে জেব্রা আর ওয়াইল্ড বিস্টদের স্নানের দৃশ্য দেখে আবার এগিয়ে চলা। আমরা পেঁৗছলাম এক বিশাল ঘাসজমির সামনে। সেখানে খানদুয়েক প্লেন দাঁড়িয়ে আছে। লেখা রয়েছে কিকোরোক এয়ারস্ট্রিপ উচ্চতা ৫৫৭০ ফুট। আমরা এতটা উচ্চতায় আছি ভাবতে পারিনি। শুনলাম এই ছোট ছোট প্লেনগুলিেত চড়ে আকাশপথে মাসাইমারা জঙ্গল আর বন্যপ্রাণী দেখানো হয়। স্থানীয় মাসাই মহিলারা এখানে হস্তশিল্পের সম্ভার নিয়ে দোকান সাজিয়ে বসেছে। কিছুক্ষণ এখানে সময় কাটিয়ে আবার এগিয়ে চলি। ওয়াইল্ড বিস্ট আর জেবরার জটলা তো সব সময়েই দেখতে পাচ্ছি। এবার তার সঙ্গে জিরাফের দলও হাজির। মাটির ওপর জীববৈচিত্রের জন্য গাছে বা আকাশে পাখিদের দিকে নজর সেভাবে দেওয়া হয়নি। তাছাড়া পক্ষী বিশারদ নই যে সঠিকভাবে পাখি চিনতে পারব। তবু নানা সময়ে ব্লু স্টারলিং, ভালচার গ্রে ক্রাউডেড ক্রেন, হেরণ, প্লোভার, সোয়ালো প্যারাডাইস ফ্লাইকেচার ইত্যাদি পাখিদের এক পলকের জন্য দেখলেও তাদের ছবি তোলার ধৈর্য বা সময় ছিল না। তবে সেক্রেটারী বার্ড, অস্ট্রিচ প্রভৃতি বড় পাখিদের ক্যামেরাবন্দী করতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। হঠাৎই দেখা হয়ে গেল গাছের নীচে উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে এক চিতা শুয়ে রয়েছে। দুপুর দু’টো বেজে গেছে এবার খাওয়া দাওয়ার পালা। এক ঘাস জমিতে গাছের তলায় আমাদের চারটে গাড়ি থামল। আগেই দেখে নেওয়া হয়েছে গাছের ডালে কোনও চিতা বা সিংহ ওৎ পেতে বসে আছে িকনা! থাকলে আমরাই তাদের লাঞ্চ বক্সে রয়েছে স্যান্ডউইচ, ডিম সিদ্ধ, ফিস ফ্রাই, কেক বিস্কুটের ছোট প্যাকেট, চিপসের প্যাকেট আর ফলের রসের প্যাকেট। লাঞ্চ প্যাকেটের সদব্যবহার করে আবার যাত্রা শুরু। এবার এতদিন যা বইয়ের পাতায় দেখেছি তা প্রত্যক্ষ করলাম। সরু রাস্তার বাঁকে ঘাস জঙ্গলের ধারে একটা ন্যাড়া গাছের বেশ উঁচু ডালে পা ঝুলিয়ে ঘুমন্ত সিংহী। গাড়ির শব্দে সিংহী চোখ মেলে তাকাল। আমাদের ক্যামেরা তৈরিই ছিল পট পট করে কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। এত বড় সিংহী অবলীলাক্রমে গাছের উঁচু ডালে উঠে ঘুমাচ্ছে– সতি্যই আশ্চর্য! এরপর বোধহয় দেখতে চাওয়ার আর কিছু নেই। কিন্তু আমাদের ভাগে্য আরও ছিল সরু একটা গাছের মগডালে শকুন আর তার পাশে একটা ছোট জলের মারিবু স্টর্ক। মারিবু বিশাল বক জাতীয় পাখি মাথায় ও গলায় পালক নেই, জীবন্ত বা মৃত সব কিছুই তার খাদ্য তালিকায় আছে। গাড়ি এখন বেশ দ্রুত গতিতে চলছে হঠাৎই সামনের গাড়িগুলি আস্তে আস্তে থেমে গেল। কারণআর কিছুই নয়, গাছের নীচে জোড়া চিতা বসে আছে। চিতারা সাধারণত একটু লুকিয়ে থাকতে ভালবাসে, তাই সহজে তাদের হদিশ পাওয়া যায় না। কিন্তু এতো মেঘ না চাইতেই জল! এবার আর পিছনে ফিরে নয়, একেবারে মুখোমুখি। চিতা সম্পর্কে তথ্য যোগায় ক্রিশ– চিতা সবচেয়ে জোরে দৌড়ায়, এদের দু’চোখের কোনা থেকে ঠোঁট পর্যন্ত দুটো কালো দাগ আছে, দিনের বেলায় শিকার করার সময় ওই দাগ দু’টোর জন্যেই চিতার চোখ রোদে ধাঁধিয়ে যায় না। আমরা অবশ্য চিতার দৌড়ের নমুনা দেখতে পেলাম না। তারা স্থির হয়ে গাছের নীচেই বসে রইল।

এবার এক টানা অনেকটা পথ গাড়ি চলল এসে পৌঁছলাম কেনিয়া তানজানিয়ার সীমান্তে। সীমান্ত চিহ্নিত রয়েছে,  তা পার হলেও কেউ বাঁধা দিল না। আর একটু এগিয়েই মারা নদী। এ নদী কিন্তু ভয়ংকর কারণ এখানে আছে অসংখ্য  কুমির আর অনেক হিপো। মাইগ্রেশনের সময় ওয়াইল্ড বিস্ট, জেবরা প্রভৃতি তৃণভোজী প্রাণী মাসাইমারা থেকে সেরেংগেটি যাওয়া অথবা ফেরার সময় এই নদী অতিক্রম করেতে হয় তখন এই নিরীহ প্রাণীগুলি ওই ভয়ংকর কুমিরদের হাতে পড়ে– নদীর জল লাল হয়ে যায় রক্তে। তবে আমরা এই স্বল্প ক্ষণের অবস্থানে এরকম কোনও ঘটনা দেখতে পেলাম না। তবে জলে কুমির ও হিপোদের দর্শন হল। নদীর ধারে টহল রত এক তানজানীয় রেঞ্জারকে ২০ ডলার দিয়ে সন্তুষ্ট করায় সে আমাদের নদীর পাড় ধরে নদী পারাপারের ব্রিজ পর্যন্ত নিয়ে গেল। কুমির ও হিপোদের আরও ভালভাবে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হল। এবার আমরা ফিরে চলি আমাদের ক্যাম্পে। সন্ধে ৬টার পর এই জঙ্গলে ঘোরা নিষিদ্ধ।

পরের দিন খুব ভোরে মাসাইমারায় একটি অল্প সময়ের গেম ড্রাইভের ব্যবস্থা হয়েছে। ভোরের জঙ্গল প্রত্যক্ষ করার জন্য। ভোর ছ’টায় আমরা বেরিয়ে পড়েছি, তখন সবে আকাশে আলো ফুটছে। সূর্যদেব আত্মপ্রকাশ করেনি। গাড়ির হুড খোলা শন শন করে ঠাণ্ডা বাতাস আছড়ে পড়ছে। মিনিট দশেকের মধে্যই আমরা পার্কের সামনে। দিগন্ত বিস্তৃত সাভানার জঙ্গলে গোলাপি আকাশে সূর্যোদয় হচ্ছে। মাসাইমারার দিনের জগৎ জাগতে চলেছে। দূরের টিলার ফঁাক দিয়ে সূর্য আত্মপ্রকাশ করে সবুজ ঘাস জমিতে আলোকিত করছে। প্রথমে নজরে এল মাঠের মধ্য অসংখ্য স্পটেড হায়নার আনাগোনা। এই ভোরবেলাতেও অনেক গাড়ি বেরিয়ে পড়েছে। সব গাড়িগুলো হঠাৎ পশ্চিমমুখে দৌড় লাগিয়েছে। নিশ্চয়ই সিংহের দেখা পাওয়া গেছে। আমাদের গাড়িও ছুটল সেই দিকে। রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে জানোয়ারের জটলা সেখানে গোটা চারেক িসংহ সিংহী ও শাবক বসে আছে মুখে তাদের প্রশান্তি অর্থাৎ সকালের খাবার খাওয়া হয়ে গেছে। সামনেই পড়ে আছে বড় কোনও জানোয়ারের দেহ যার সিং ও সামান্য অংশ মাত্র পড়ে আছে। হায়নার দল তাতেই ভোজ লাগিয়েছে। একটু পাশে অপেক্ষা করছে শকুনের দল। হায়নারা খাওয়া শেষ করলেই তারা শুরু করবে। অনেকটা নিশ্চিন্তভাবে ওয়াইল্ড বিস্ট ওজেবরার দল কাছে পিঠেই ঘোরাঘুরি করছে। কিছুক্ষণ হায়নাদের খাওয়া দাওয়া দেখে এগিয়ে চলি। সিংহরা তখনও একইভাবে বসে আছে। আজেকে আমরা আর মামুলি জন্তু জানোয়ার ওয়াইল্ডবিস্ট জেব্রা ও অন্যান্য অ্যান্টিলোপদের দেখতে সময় দিচ্ছি না। আরওবড় পুরস্কারেরর আশায় ঘুরছি। তা দশ মিনিটের মধ্যেই পাওয়া গেল। এক অতিকায় বাওয়াব গাছের তলায় জোড়া চিতাবাঘ, একে অন্যের দিকে চেয়ে বসে রয়েছে। তারপরই মুখ ঘুরিয়ে প্রকৃতি অবলোকনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যেন একেবারে ‘মেড ফর ইচ আদার’। 

আমাদের ভোরের গেম ড্রাইভের সময় সীমা অতিক্রান্ত হয়ে আসছে। মাসাইমারার সাভানার সহস্র নাটকের রঙ্গমঞ্চ থেকে আমরা বিদায় নিই। ব্রেকফাস্ট সেরেই আমরা মালপত্র নিয়ে ক্যাম্প ত্যাগ করলাম। সঙ্গে নিয়ে গেলাম এনকোবো ওয়াইল্ড লাইফ ক্যাম্প সম্পর্কে এক তিক্ত অভিজ্ঞতা।

আমরা এখন মাসাইমারা গ্রামে গিয়ে তাদের জীবনযাত্রার এক চিত্র দেখার উদ্ে্যাগ নেব। মাসাইদের গ্রামে ঘোরা তাদের ছবি তোলা ইত্যাদির জন্য কিন্তু মাথাপিছু ২৫ ডলার অর্থাৎ ২৫০০ কেনিয়ান শিলিং দিতে হবে। গ্রাম প্রধানের ছেলে বয়সে যুবক প্রথমে আমাদের সঙ্গে আলাপ করল। বেশ ভাল ইংরেজী বলতে পারে। তাকেই সব টাকা পয়সা বুঝিয়ে দেওয়া হল। ছেলেটির পোশাক মাসাই আদিবাসীদের মতই, গায়ে লাল মোটা চাদর গলায় কানে নানা গয়নাগাটি। সেই আমাদের নিয়ে চলল গ্রামের ভিতরে। প্রথমে দেখলাম মাসাই নৃত্য। নৃত্য মানে একদল পুরুষ মাসাই গোল হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরতে লাগল তাদের গানের ছন্দে। তারপর এক এক জন করে উঁচুতে লাফাতে লাগল। কে কত উঁচুতে লাফাতে পারে তা কিন্তু তাদের বিয়ের সময় এক বিচার্য বিষয়। এই নৃত্যগীতে কিন্তু কোনও মহিলা মাসাই অংশগ্রহণ করেনি। এরপর গ্রামের সামনের মাঠে মাসাই প্রথায় কোনও দেশলাই বা লাইটার ছাড়াই আগুন জ্বালানোর পদ্ধতি দেখাল এক মাসাই যুবক। গ্রামের ঘরে ঘরে ঘুরে তাদের ঘর কন্নার চিত্রও দেখলাম। খুবই দরিদ্র এরা। মাটির বাড়ি, কয়েকখানা ঘর, রান্না ঘরের পাশেই শয়নকক্ষ রয়েছে। অতিথিদের জন্যও রয়েছে এক কক্ষ। তাদের রান্নার এক বিশেষ পদও দেখলাম রান্না হতে। গরুর মাংস খন্ড, কঁাচা দুধ ও টাটকা গরুর রক্ত হচ্ছে তার উপাদান। এরপরই তাদের তৈরি নানা হস্তশিল্প অতিথিদের দেখিয়ে বিক্রির প্রচেষ্টা। গ্রামের পাশেই বাচ্চাদের স্কুল তার সামনের মাঠে মাসাই পড়ুয়ারা ভলিবল খেলছে। আমাদের এবার বিদায়ের সময় এসে গেছে। বিদায় মাসাইমারা, বিদায় কেনিয়া, বিদায় আফ্রিকা।

মাসাইমারা থেকে লম্বা পথে রিফট্‌ভ্যালি হয়ে নাইরোবি বিমান বন্দর।                                       

 ছবি : লেখক