সম্বলপুর এক্সপ্রেসে মনােহরপুর যখন নামলাম তখন রাত শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। কিন্তু আকাশে শেষ রাতের তারাগুলি দেখা যায়। ট্রেন থেকে আমরা দুজন আর চা-ওলা ছাড়া আর কেউ বিশেষ নামে নি। কলকাতায় নভেম্বরের প্রথমে হালকা শীতের আমেজ থাকলেও মনােহরপুরে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে গিয়েছে। প্ল্যাটফর্মেই ঝকড়া একটা নিমগাছের তলায় এসে দাঁড়াই। ওখানে বেশ কিছু আদিবাসী জটলা পাকিয়ে আগুনজ্বেলে বসে আছে। দূরে টিমটিম করে জ্বলছে ইস্টিশনের বাতি। এই সব আদিবাসীরা সম্ভবত আগের প্যাসেঞ্জার ট্রেনটিতে এসেছে। একটু আলাে ফুটলেই এরা স্টেশনের বাইরে গিয়ে বাস ধরে যাবে বলকোবাদ, মেঘাতাবুরা, চাইবাসা আরাে কত অজানা প্রত্যন্ত প্রান্তরে। খানিকক্ষন বসে থাকার পর পুবের আকাশ ফর্সা হলাে। শুকতারা পশ্চিমাকাশে এখনাে জ্বলজ্বল করছে। একটু বাদেই ভােরের আলােয় উদ্ভাসিত হবে চারিদিক। স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়াই। ঝাড়খণ্ড ও ওড়িষ্যার সীমানা মনােহরপুর ছােট্ট জনপদ। শাল, সেগুন, আকাশমণি আর মহুয়ার ছায়া ঘেরা ছােট ছােট টিলার মধ্যে দিয়ে গ্রাম্য রাস্তা চলে গিয়েছে। রাস্তার অবস্থা বেশ খারাপ। এই রাস্তা দিয়েই চলেছে বাইশ সিটের মিনিবাস। অদিবাসীদের অধিকাংশই সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা প্রজাতির প্রায় নব্বই ভাগই খ্রীস্টান। আমাদের গন্তব্য সন্তুর | রিসর্ট। ঠিকানা পেয়েছিলাম অফিসের সহকর্মীর কাছে। সন্তুরের অভর্থনা কক্ষটি বেশ সুন্দর। নানা ধরনের
টালির চাল এর মাঝে চেয়ার টেবিল অফিসের কাগজপত্র। সংস্থার কর্ণধার অভিজিৎ গাঙ্গুলি অত্যন্ত অতিথি পরায়ণ মানুষ। ওনার বাবা একসময় ইসকোর ডাক্তার ছিলেন। সারান্ডার অরণ্য -প্রকৃতিকে গভীর ভাল বাসতেন। তার চিহ্ন রেখেছেন নিজের আঁকা সারান্ডার পটভূমিকায় বিভিন্ন চিত্রে। তাতে রয়েছে আদিবাসী রমণী, ঝর্ণা, অরণ্যভূমি। প্রত্যেক ঘরেই টাঙানাে এই রকম অসধারণ কিছু ছবি। ঘরের সামনে টাঙানাে আছে সারান্ডার ম্যাপ। সকলকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হল সকালের প্রাতরাশের জন্য। খাবার জায়গাটিও অসাধারণ। চারিদিক খােলা খেতে বসেই নজরে পড়ে দুরের মুক্ত বনাঞ্চল, ধোঁয়ার মতাে পাহাড়ের শ্রেণী। দূরে যে ধোঁয়ার মতাে পাহাড় দেখা যায় ওটাই সেলের চিড়িয়া আয়রণ মাইনস। আকরিক লােহা সমৃদ্ধ লাল হিমাটাইট পাথর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রৌঢ়কেল্লা স্টিল প্ল্যান্টে। বিকালের দিকে রওনা হই গ্রামের পথে। সামনে একটি টিলা, খুব ছােট। একে টিলা না বলে ডুংরা বলাই ভাল। রাস্তা সােজা উঠে গিয়েছে টিলার উপরে। বনতুলসী আর কুলের ঝােপ জঙ্গল। হাতে করে পাতা সরিয়ে ওপরে উঠতে হয়। খুব একটা চড়াই নয়। উঠতে মােটেই কষ্ট হচ্ছে না। বরং বেশ অ্যাডভেঞ্চার লাগে। ডানদিকে নীচে ঢালু জমিতে ছােট একটি চার্চ দেখি। অপরাহ্নের প্রাক্কালে ঘন্টা বাজছে। দূরে ছড়িয়ে যাচ্ছে সেই শব্দ। ওপরে উঠে অসাধারণ দৃশ্য দেখি। দুপাশে পাহাড় মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে কোয়েল, কোয়েল নদী। ষাটের দশকে সত্যজিৎ রায় পালামৌ-এর জঙ্গলকে কেন্দ্র করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাহিনি আহলম্বনে যে কালজয়ী ছায়াছবি ‘অরণ্যের দিবারাত্রি তৈরী করেছিলেন। তাতেও দেখানাে হয়েছে কোয়েল নদী আর বিস্তৃর্ণ অরণ্যকে। সেটা কিন্তু নর্থ কোয়েল বা আপার কোয়েল। বুদ্ধদেব গুহর বিখ্যাত উপণ্যাস কোয়েলের কাছে তে তিনি যে কোয়েলের বর্ণনা করেছেন সেটিও আপার কোয়েল বা নর্থ কোয়েল। আমাদের সামনে যে কোয়েলকে দেখছি সেটি সাউথ কোয়েল বা লােয়ার কোয়েল। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। পূর্ব আকাশে পাহাড়ের গায়ে আলাে দেখি। স্থানীয় আদিবাসীদের মুখে জানতে পারি ওই আলােগুলি চিড়িয়া মাইনসের আলাে। সেখানে দিনরাত পাথর ভাঙার কাজ হচ্ছে।
পরদিন সকালে আমরা চিড়িয়া মাইনসে যাব। একটু বেলা করেই বেরুব। পথে দুরদরিতে কারাে ও কোয়েনা নদীর সঙ্গমস্থলে দুপুরের আহার সারব। এই মুক্ত প্রকৃতির মাঝে লাঞ্চ অভিজিৎবাবুর নতুন সংযােজন। দুরদুরি জায়গাটি ভীষন সুন্দর। দুপাশে পাহাড়ের বুক চিরে কারাে নদী বাঁদিক থেকে বেরিয়ে আসা কোয়েনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। চারিদিকে গভীর জঙ্গল। দিনের বেলাতেই গা ছমছম করে। তােয়ালে সঙ্গেই রয়েছে। সমনে কারাে নদী কুলকুল করে বয়ে চলেছে। নদীর শীতল জলে স্নান করে সিগ্ধ হই। নদীর পাড়ে সতরঞ্চি বিছিয়ে বসেছি। খানিক পরে হইহই করে আসে কলেজের মেয়েগুলি। ওরাও চিড়িয়ার দিকে। চলেছে। চিড়িয়া মাইনস দেখে সত্যিই অবাক হয়ে যেতে হয়। বিরাট পাহাড়টা ধীরে ধীরে ভেঙে আকরিক লােহা সমৃদ্ধ পাথর তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমাকে ড্রাইভার হেসে বলেছিল যেহারে পাথর ভাঙা হচ্ছে তাতে সমস্ত পাহাড়টি শেষ হতে প্রায় শতশ বছর লাগবে। গত নব্বই বছরে পাহাড়ের মাত্র সামান্য অংশ ভাঙা হয়েছে। চিড়িয়ার ওপরটা বেশ উচুভীর গজঙ্গলে ঢাকা। এখান থেকে বাঁ দিকে মেঘাতাবুরা ও কুয়া রেঞ্জ দেখা যায়। সন্তুরে যখন ফিরলাম তখন সন্ধ্যে নেমে গিয়েছে। চাঁদনী রাত, আমরা ঘর ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়াই। দূরে জ্যোৎস্না প্লাবিত অরণ্য। চিড়িয়া মাইনসে পাহাড়গুলিকে কেমন ছায়া ছায়া ভৌতিক লাগে। গাছের তলায় সিমেন্ট বাঁধানাে বসার জায়গা। হেমন্তে আকাশমনি গাছে ধিকধিক করছে চাপা হলুদ ফুলগুলাে। কিছু পরে রাত আরাে নিস্তব্ধ হলে কানে ভেসে আসে বাঁশির করুণ শব্দ আর মাদলের দ্রিম দ্রিম তাল।
সকালবেলা জঙ্গলের পথে বেড়ানাের আনন্দই আলাদা। শিশির ভেজা বুনাে পাতা মাড়িয়ে জঙ্গলের পাকদন্ডী পথে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যাই অনেকদূরে। ফিরে আসার মুখে কলেজের একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। জিজ্ঞাস করে, “ঘুরে এলেন? দারুণ না!’ ছােট ডুংরি পেরিয়ে লাইনের ধার বরাবর চলে আসি কোয়েলের কাছে। রেল লাইনটা একটা বাঁক নিয়েছে এখানে। বালির চড়ায় আকন্দ আর ফণীমনসা গজিয়েছে এখানে সেখানে। সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে চলি কোয়েলের কাছে। শুনেছি এখানে চোরাবালি আছে। পা বসে যায়। হাঁটু জল বরাবর নেমে যাই কোয়েলে। অজস্র মাছ খেলা করছে। বেলায় বেশ রােদ উঠেছে। ইস্পাত এক্সপ্রেসেই ফিরব বলে ঠিক করেছি। বাঁশি বাজিয়ে ট্রেন এসে যায়। মাত্র দু মিনিটের স্টপেজ আবার ছেড়ে দেয়। বিদায় মনােহরপুর।
প্রয়ােজনীয় তথ্য :. দক্ষিণপূর্ব রেলওয়ের টাটানগর-রৌঢ়কেল্লা সেকশনের ছােট স্টেশন মনােহরপুর কলকাতা থেকে ৩৭৪ কিলােমিটার দূরত্বে অবস্থিত। ইস্পাত, সম্বলপুর, কুরলা এক্সপ্রেস মনােহরপুর ছুয়ে যায়। মনােহরপুরের একমাত্র রিসর্ট সন্তুর। থাকা খাওয়া বাবদ জনপ্রতি দৈনিক ৫৫০ টাকা। খাওয়ার মান যথেষ্ট উন্নত মানের। ফোনে অভিজিৎবাবুর সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ করতে পারেন। ডাকেও জবাবী খানে চিঠি পাঠিয়ে যােগাযােগ করতে পারেন। ঠিকানা .. অভিজিৎ গাঙ্গলী প্রযত্নে সন্তুর, পােস্ট ও থানা মনােহরপুর, জেলা-পশ্চিম সিংভূম, ঝাড়খন্ড। ফোন :. ০৬৫৯৩২৩২৫৩৫/ ৯৪৩১৩০৪৯১৬।
0 Comments