গীতালি লাহিড়ী



উৎসব বহু মানুষের সম্প্রীতি স্নিগ্ধ মিলনের ক্ষেত্র প্রশস্ত করে। উৎসবের সন্ধানে এসে ধরা দেয় বহু মানুষ। এখানেই তো উৎসবের সার্থকতা। বিশ্বকবি বলেছেন, প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী, কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হয়ে বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করে বৃহৎ। উৎসবের আনন্দে আমাদের কাজকর্ম এক বিরাট মঞ্চে পরিণত হয়। আমাদের উৎসব অনুষ্ঠানগুলো এভাবেই সকলের শুভ কামনায়, সকলের প্রীতিতে সার্থক হয়ে ওঠে। উৎসব বহু মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে ভালবাসার সেতুবন্ধন, সমগ্র মানব জাতীর ঐক্যের মূল সুরটি এর মধ্যে নিহিত। আমাদের ঘিরে অভাব—অনটন আছে, ব্যাঘাত আছে, আছে দিন যাপনের, প্রাণ ধারণের তুচ্ছতা, ক্ষুদ্রতার চরম গ্লানি। এসব থেকে সাময়িক মুক্তি লাভের জন্যই উৎসবের প্রয়োজন। এই উৎসব জীবনে আনে বেগ, ভাবনায় আনে আবেগ। 

নেপাল সরকার ২০২০ সালকে পর্যটন বর্ষ হিসাবে ঘোষণা করেছেন। পর্যটন বর্ষকে সাফলে্যর শীর্ষে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে নেপালের ঝাপা জেলার অন্তর্গত মেচিনগর কাকরভিট্টায় ষষ্ঠ এশিয়ান গ্রামীন পর্যটন উৎসবের শুভ সূচনা হয়। ৯ই ফেব্রুয়ারি। প্রদেশ নং (১) মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় শেরধন রাই দ্বারা এই মহোৎসবের উদ্বোধন হয়। কাকরভিট্টা বাসস্ট্যান্ডে এই উৎসবের শুভ সূচনা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন এই উৎসব সারা বিশ্বের কাছে নেপালকে এক বিশেষ জায়গায় পৌঁছে দেবে। মুখ্যমন্ত্রী রাই মনে করেন নেপাল এক সুন্দর শান্ত জায়গা।

এই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির আসন অলংকৃত করেন ইংল্যন্ডের ফোকস্টোন শহরের মেয়র Jakkic Meade. তিনি ঘোষণা করেন ১,০০,০০০ ব্রিটিশ পর্যটক এইবছর নেপাল ভ্রমণে আসবেন। ফোকস্টোন শহর গোর্খাদের ঘর একথা বলে উনি আরও বলেন আমরা এক পরিবার।

এশিয়ান গ্রাম্য পর্যটন মহোৎসবের আয়োজক কমিটির অধ্যক্ষ শ্রী অর্জুন কার্কি বলেন, পর্যটন প্রকৃতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত। সেই কারনেই এই বছর এই উৎসবের বিষয়, ‘প্রকৃতি র সংস্কৃতি, পর্যটন কো সম্পতি’ (essence of tourism embeded nature and culture) এই উৎসবের মুখ্য উদ্দেশ্য গ্রামের যে সুন্দর পর্যটনের স্থান, সেখানে যে কৃষি নির্ভর বসতি, তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে প্রকাশ্যে আনা। এই উৎসবে বিভিন্ন স্টলে প্রদর্শিত হয়েছিল গ্রামের মানুষদের তৈরি  খাবার, হাতের কাজ প্রভৃতি। এই উৎসবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভারত নেপালও ভুটানের শিল্পীরা অংশ গ্রহণ করেছিলেন তাদের নিজস্ব শিল্প শৈলী নিয়ে। নেপালে উৎপাদিত বঁাশ দিয়ে তৈরি রকমারি ঘর সাজানোর সামগ্রী সকলের বিশেষ নজর কাড়ে।

East Horizon English High School এর ছাত্রীরা উদ্বোধনি নৃত্য পরিবেশন করে।  ভারত থেকে YLTP লোক সংস্কৃতি দল, Dukpa লোক সংস্কৃতি দল ও গারো লোক সংস্কৃতি দল তাদের নৃত্য পরিবেশন করেন প্রধান মঞ্চে। পশিচম বঙ্গের কলকাতা থেকে চিত্র শিল্পী অজয় দিন্দা, শিল্পী সুজাতা দে, শিলিগুরি থেকে চিত্র শিল্পী অজয় সরকার এসে তাদের শিল্প কলায় উৎসব প্রাঙ্গন মাতিয়ে রাখেন। কালিম্পং থেকে অনুপম, ভিকি তাদের পরিবেশিত গানে সবার মন জয় করে নেন। শিলিগুড়ির The Sunday Haat—এর সদস্যরাও তাদের তৈরি আচার ঘর সাজানোর বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে পসরা সাজিয়ে মেলা প্রাঙ্গনে বসেছিলেন। 

এই উৎসবে যোগ দিতে ভারত থেকে এসেছিলেন Confederation of Indian Industry. HHTDN. Association for Concervation and Tourism, The Sunday Haat, Siliguri Homestays.

এই উৎসবে নেপালের গন্ধর্ব শিল্পী সহ বিভিন্ন জায়গার শিল্পীদের দ্বারা পরিবেশিত নৃত্যগীত এক বিশেষ মাত্রা যোগ করে।

এই উৎসবে নেপালের কবি, ভারতের কবি ও ব্রাজিলের কবিদের নিয়ে বসেছিল কবি সম্মেলন। উপস্থিত ছিলেন ভারত থেকে দেবজ্যোতি লাহিড়ী এবং ব্রজিল থেকে ইটালো রোভেরো। যা সকলের নজর কাড়ে এছাড়া ছিল এশিয়ান গ্রামীণ পর্যটন উৎসবের অধ্যক্ষ শ্রী অর্জুন কার্কীর বঁাশি। তার বঁাশির সুরে মেলা প্রাঙ্গন মেতে ওঠে। এখানে কিছু বাংলা লোকসঙ্গীতের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশিত হয়। যা খুবই সুন্দর। নেপালের অন্যতম প্রাচীন শিল্পী গোষ্ঠী গন্ধর্ব লোকশিল্পী গোষ্ঠী। যখন গণমাধ্যম ছিল না তখন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কথা, সংবাদ, বার্তা সঙ্গীতের মাধ্যমে পেঁৗছে দিত এই গন্ধর্ব শিল্পীগোষ্ঠী। এই উৎসব  প্রাঙ্গন মাতিয়ে তুলেছিল এদের পরিবেশিত লোক সঙ্গীত।

এখানে খাবারের স্টলগুলিও ছিল লোভনীয়। শেল রুটি, মোমো, নেওয়ারি থালি, জিলিপী, সিঙ্গারা, মালপোয়া, ভাপা পিঠে প্রভৃতি।

হোমস্টে পর্যটনকে আরও সমৃদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ভারত, নেপাল ও ভুটান এই তিনটি দেশের মধ্যে যারা হোমস্টে চালু করেছেন তাদের নিয়ে ১০ই ফেব্রুয়ারি বসেছিল হোমস্টে সম্মেলন। 

এশিয়ান গ্রামীণ পর্যটন উৎসবের এই আসর বসেছিল উৎসবের অধ্যক্ষ শ্রী অর্জুন কার্কির মেচি জস্কেলো রেস্তোরাঁতে। এই সম্মলনের মধ্যস্থতা করেন Mr. Kamal Aryal, Associate NRM Specialist, ICIMOD. এখানে যাঁরা বক্তব্য রাখেন তঁারা হলেন Mr. Bishnu Lal Ghimirc, Divisional Forest Office, Jhapa.

এই সম্মেলনের বক্তব্য সংক্ষেপে তুলে ধরেন Dr. Anu Kumari Lama, Tourism Specialist, ICIMOD.

উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন লীলা ভট্টরাই, চেয়ারপার্সন, মাইপোখরি হোমস্টে ম্যানেজমেন্ট কমিটি, KL-Nepal, এছাড়া যাঁরা বক্তব্য রাখেন তারা হলেন, Mr. Marmit Lepcha, Homestay Operator, Dzongu, Kl India, Mr. Suman Rai, Homestay Operator, Ribdi, KL-India, Ms Kausila Moktan, Home stay Operator, Salakpur, Kl-Nepal, Mr, EK Raj Ghimire. Antu Homestay, Province-1, Homestay Operator, North East India. প্রতিবেদক Biraj Adhikari, Research Fellow, Ecosystem Services. ICIMOD এই সম্মেলনে হেল্প টু্যরিজম—এর প্রতিষ্ঠাতা শ্রী রাজ বাসুর বক্তব্য উপস্থিত সভ্যদের মনে বিশেষ জায়গা করে নেয়। আমরা পর্যটন বিশেষজ্ঞ শ্রী রাজ বাসুর বক্তবে্য জানতে পারি উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি দিয়ে নেপালের কাকুরভিটায় মেচি নদীর ওপারে যে নেপালের প্রবেশদ্বার সেটা হল পূর্বতম আন্তর্জাতিক প্রবেশপথ। ব্রিটিশরা যখন প্রথম দার্জিলিংকে খুঁজে পায়, তখন তারা এই মেচি নদীর পধ ধরেই হেটে গিয়েছিল। যার জন্য দু’দিকটাই আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও বলেন নেপাল, উত্তরঙ্গ ও সিকিমকে একসঙ্গে নিয়ে Joint Circuit কি করে করা যায়, সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ও তারই একটি প্রতিফলন আমরা আমাদের এশিয়ান গ্রামীণ পর্যটন উৎসবে দেখতে পাই। এর সঙ্গে যেটা জড়িয়ে আছে সেটা শুধু সংস্কৃতি নয়, প্রকৃতিকেও বিশেষভাবে দেখতে পাই। প্রকৃতির যে সম্পদ সেখানে হাতির পরিবেশ থেকে শুরু করে রেড পান্ডার পরিবেশ পুরোটাই যাতে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়।

আগামী দিনে কাঞ্চনজঙ্ঘা হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত হোমস্টে পর্যটন এক রোল মডেল রূপে তৈরি হতে চলেছে। ভূটানের, সিকিমের, উত্তরবঙ্গের ও পূর্ব নেপালের হোমস্টে নিয়ে একটা সার্কিট বানানোর পরামর্শ এসেছে। ওই পরামর্শ মেনে গ্রামীণ পর্যটনকে তুলে ধরতে চান, একথা জানান ডঃ নকুল ছেত্রী। পর্যটন বিশেষজ্ঞ ইসিমোড নেপাল।

নেপালের সলকপুর রুদ্রাক্ষ, কমলালেবুর জন্যে বিখ্যাত। এছাড়া জৈব পদ্ধতিতে বিভিন্ন কৃষিকাজ হয়। কৃষি ও প্রকৃতি পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণের স্থান এই সলকপুর। অপরূপ সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায় এই সলকপুর থেকে। এখানকার হোমস্টে থেকে প্রকৃতিকে খুব সুন্দরভাবে উপভোগ করার সুযোগ মেলে। নেপালের বিভিন্ন গ্রাম থেকে দূরে ভারতের মিরিক, কার্শিয়াং পাহাড়ের দৃশ্য দেখা যায়। সালকপুরে সিদ্ধা নদী আছে। এখানে মাছ ধরা যায়। প্রকৃতিবান্ধব হোমস্টে আছে। অন্যতম অর্থকরী ফসল ঝাড়ু। এখানকার গ্রীন টি বিখ্যাত।

এবার একটু নিজের কথায় আসি। এই উৎসবের মাঝেই আমরা তিন বন্ধু ও ফ্রান্সিস মিলে খুব সুন্দর কিছু জায়গা বেড়ানোর সুযোগ পাই। যেদিন আমাদের উৎসব উদে্যাক্তাদের উদে্যাগে সলকপুর বেড়াতে যাওয়ার কথা সেদিন শিলিগুড়ি থেকে কাকুরভিট্টা পৌঁছতে দেরি হওয়ায়, আমরা সলকপুর যাওয়ার বাস ধরতে পারি না। তখন আমাদের শ্রী অর্জুন কার্কি একটা অটো ঠিক করে দেন। তাতেই চেপে আমরা নেপালের ঝাপা জেলার বামনডাঙ্গির মিনি মাউন্টেন ও কৃষ্ণ মন্দির দেখতে যাই। পথের দু’ধারে রকমারি ফুলে সাজানো গ্রাম দেখতে দেখতে আমরা সুন্দর এক দোলনা সেতু দেখতে যাই।  দুরত্ব কাকুড়ভিটা থেকে ৩০ কিমি। সেখানে আমি, চন্দ্রা বৌদি, নিলীমা ও ফ্রান্সিস উঠে পড়ি। অপূর্ব সেই অভিজ্ঞতা, ওই সেতুতে উঠে অনেক ছবি তোলার পর আমরা সেতু থেকে নেমে নদীর কাছে যাই নদীর ধারেই গাছের ছায়ায় অনেকে বনভোজন করতে এসেছিল। আমরা সেই ভিড় এড়িয়ে চলে যাই পাহাড়ের কাছে। তারপর আমাদের পাহাড় চড়ায় পারদর্শী ভাই ফ্রান্সিসের সহায়তায় পাহাড়ে উঠি। সে এক দারুণ আনন্দ। মনে হল যেন কত কঠিন কাজ আমরা করে ফেলেছি। এর মাঝেই অনেক পাখীর কলকাকলি আমায় পাখীর কাছে যাওয়ার নেশা আরও বাড়িয়ে দিল।

এই মিনি মাউন্টেনের পথে আসার সময় রাস্তার দু’ধারে সর্ষে ফুল যেন সোনার চাদর বিছিয়ে রেখেছে মনে হচ্ছিল। অপূর্ব এই স্বর্গীয় অনুভূতি। এমনি সময় অনেক হাটলে যে কষ্ট হয় এখানে এত হাটা ও সিঁড়ি চড়ার সময় তা মোটেই অনুভব করিনি। 

মেলা হল মিলনক্ষেত্র। এখানে বহু মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। কলকাতার সল্টলেক সিটি সেন্টারে অনুষ্ঠিত কমলা উৎসবে যোগ দিতে আসা পুরনো বন্ধুদের এখানে কাছে পেয়ে খুব ভালো লাগল। সঙ্গে অনেক নতুন বন্ধুদেরও পেলাম। উৎসবে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল শেফ Samsung Tamang-এর সঙ্গে। উনি শিলিগুড়ির প্রধাননগরে একটি রেস্তোরঁা খোলেন। যার নাম The Royal Gorkha Cusine Family Restaurant. এই রেস্তোরাঁ উদ্বোধনে আমি, চন্দ্রা বৌদি, দেবজে্যাতি লাহিড়ী ও নীলিমা আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে যাই। সেখানে রকমারি সুস্বাদু গোর্খা খাবার খাওয়ার সৌভাগ্য হয়। Mr. Tamang আমাকে আমার প্রিয় শেলরুটি অনেক দিয়ে দেন কলকাতায় নিয়ে আসার জন্যে। এমন অল্প সময়ে এত সুন্দর স্বভাবের বন্ধুদের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে আমি ধন্য।

উৎসব উপলক্ষ্যে সব মানুষের মধ্যে যে ব্যবসায়িক লেনদেন হয়, তা জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে তোলে। উৎসবের মধ্য দিয়েই সমগ্র মানবজাতির মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর ফলে সমাজ বন্ধন দৃঢ় হয়। বস্তুত সমাজের সবাইকে নিয়ে এমন সুন্দর উৎসবে একের আনন্দকে সকলের আনন্দ, একের শুভকে সকলের শুভ করে তোলার যে ইচ্ছে, তাই হল এই এশিয়ান গ্রামীণ পর্যটন উৎসবের প্রাণ।

ছবি : লেখক